চট্টগ্রামে সাক্ষী হিসেবে ৫১৮ পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

0
165
Print Friendly, PDF & Email

চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদালতে মামলার সাক্ষী হিসেবে ৫১৮ পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। যাদের অনেকে এখন অবসরে রয়েছেন। অনেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে দিব্বি চাকরি করছেন।
পুলিশের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক নোটিশ জারি করেও আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না। ফলে আদালতে নিষ্পত্তি হচ্ছে না অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা। বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরে ফিরছেন বিচারপ্রার্থীরা।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার ও নগর পুলিশের উপ কমিশনার (সদর) মাসুদ-উল-হাসানের কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশ সুপার একেএম হাাফিজ আক্তার এ প্রসঙ্গে বলেন, যেকোনো মামলায় আদালতে সাক্ষী হাজির করা পুলিশের কাজ। সে জায়গায় পুলিশ নিজে সাক্ষী দিতে না আসা দু:খজনক। তবে নানা কারণে অনেক পুলিশ সাক্ষী দিতে আদালতে হাজির হতে পারে না। চাকরি থেকে অবসর নেয়ায় অনেকে আদালতে হাজির হচ্ছে না।
তিনি বলেন, বদলি হওয়ার কারণে অনেক পুলিশ আজ দেশের এ প্রান্তে কাল অন্য প্রান্তে থাকেন। ফলে মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বেগ পেতে হয় তাদের। এর বাইরে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণসহ নিত্যনতুন ঘটনা সামাল ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মানতে গিয়েও অনেকে মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে পারে না।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিভিন্ন মামলায় সাক্ষী হিসেবে হাজিরা না দেয়ায় গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার থানাসমূহের প্রায় দেড় হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। এরমধ্যে অধিকাংশ পুলিশ সাক্ষী হিসেবে হাজির হলেও ৫১৮ পুলিশ আদালতে হাজির হননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে আনোয়ারা উপজেলার বরকল ইউনিয়নের প্রবাসী ইউনুছ হত্যা মামলা। এ মামলার সাক্ষী রয়েছেন মোট ১৩ জন। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় ইতোমধ্যে পাঁচজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। বাকি আট সাক্ষীর সবাই পুলিশ।
২০০১ সাল থেকে আদালত এই আট পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এদের মধ্যে মামলার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর রফিকুল ইসলাম ভুইয়া আজ পর্যন্ত কোনো দিন আদালতে আসেননি। আদালত এসব সাক্ষীকে হাজির করার জন্য একাধিকবার পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরও হাজির না থাকায় আদালত ওই পুলিশের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা বলবৎ রেখেছেন।
২০০৩ সালের ২৭ মার্চ নগরীর বাকলিয়া থানা এলাকায় খুন হন নুরজাহান বেগম। এ ঘটনায় থানায় বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন তৎকালীন এসআই একরাম হোসেন। মামলা দায়েরের পর তিনি কোনো দিন আদালতে হাজির হননি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রাকিব হোসেনও আদালতে হাজিরা দেননি কোনদিন। আদালত এ মামলার ছয় পুলিশ সাক্ষীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
এভাবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ৫৫টি ও জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালে ৩৫টি হত্যা মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যেগুলোর একটির বিচারও নি®পত্তি হয়নি। এসব মামলার বেশির ভাগই সাক্ষী হিসেবে পুলিশ সদস্যরা হাজিরা দিতে না আসায় বিচার কার্যক্রম থমকে আছে।
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পিপি মমিনুল ইসলাম জানান, পুলিশের দায়িত্ব যেখানে সাক্ষী হাজির করা, সেখানে পুলিশই যদি নির্ধারিত তারিখে হাজির দিতে না আসে তাহলে আদালতের কি করার আছে।
জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালের সেরেস্তাদার মোবারক আলী জানান, আদালতের হত্যা মামলাগুলোর মধ্যে অন্তত দশটি মামলার বাদীকে পুলিশ আদালতে হাজির করতে পারেনি। সে কারণে এসব হত্যা মামলার বিচারের মূল কাজ শুরু হয়নি। এ অবস্থায় আদালত একাধিক পুলিশের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
সূত্র জানায়, পুলিশ সদস্যদের আদালতে হাজির করার জন্য জেলার পুলিশ প্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের একাধিকবার তাগিদ দেয়া হলেও কার্যত কোনো ফল আসেনি। এমনকি এসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালত এর আগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দেন। তারপরও কোনো সুরাহা হয়নি।
সূত্র আরো জানায়, দীর্ঘদিন ধরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকার পরও দিব্বি চাকরিতে রয়েছেন পুলিশের অনেক সদস্য। যারা বছরের পর বছর আদালতে অনুপস্থিত থাকায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহতদের একাধিক স্বজন অভিযোগ করে বলেন, বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যাওয়ায় পুলিশ সদস্যরা আদালতে হাজির হন না। আবার এ অভিযোগ অস্বীকার করে একাধিক পুলিশ অফিসার বলেন, মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে বারবার আদালতে গিয়ে হয়রানির শিকার হন তারা। ফলে ইচ্ছা থাকলেও হাজির হন না।
সিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) রেজাউল মাসুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে জারি হওয়া অনেক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তাদের কাছে আসে না। পেশকার ও সেরেস্তাদাররা অনেক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠায় না। প্রসিকিউশন কোনও পরোয়ানা হাতে পেলে তা সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, পরোয়ানা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা নাম, পদবি, আইডি নম্বর আনুযায়ী সংশ্লিষ্ট থানায় (তৎকালীন কর্মস্থল) পাঠানো হয়। তদন্ত কর্মকর্তার স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ থাকে না থাকায় নোটিশ সেখানে পাঠানো সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় ওই পুলিশ বদলি হলে কোনো থানায় কর্মরত আছেন তা জানাও সম্ভব হয় না।
ফলে থানা থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা নোটিশ সংশ্লিষ্ট দফতরে ফেরত পাঠানো হয়। বিভিন্ন দফতর ঘুরে যখন সংশ্লিষ্ট সাক্ষীর (পুলিশ) হাতে ওই নোটিশ পৌঁছে ততদিনে মামলার তারিখও পার হয়ে যায়। এভাবেই দিনের পর দিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার সাক্ষী আদালতে হাজির না হওয়ায় মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
অথচ ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস ভলিউম-১ অনুযায়ী, সব সাক্ষীকে নির্ধারিত তারিখে আদালতে হাজির করার দায়িত্ব পুলিশ ও প্রসিকিউশনের। অথচ এসব পুলিশ সাক্ষী আইন অমান্য করে আদালতে হাজির হচ্ছেন না। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে বিচারাধীন মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রম।

শেয়ার করুন