জঙ্গি ছিনতাই বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন এসপিসহ ছয়জন অভিযুক্ত

0
241
Print Friendly, PDF & Email

ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে পুলিশকে খুন করে তিন জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপারসহ জেলা পুলিশের ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বলা হয়, তাঁদের অদক্ষতা ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেদনে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাকে ‘একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফসল’ বলে মন্তব্য করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারাগারে বসেই কয়েদিরা মুঠোফোন ব্যবহার করে সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এর সঙ্গে কারা কর্মচারীদেরও যোগসাজশ ছিল।
অভিযুক্তরা হলেন গাজীপুরের পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন, এএসআই হাবিবুর রহমান, আয়ুব আলী ও সাইদুল করিম, আরআই ইমব্রাহির খান এবং প্রিজন ভ্যান চালক সবুজ মিয়া। তবে কারাগারে মুঠোফোন ব্যবহারের বিষয়ে বলা হলেও প্রতিবেদনে এর জন্য নির্দিষ্ট করে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে তিন জঙ্গিকে ময়মনসিংহে নেওয়ার পথে ত্রিশাল এলাকায় পুলিশের প্রিজন ভ্যানে হামলা করে তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। এতে ঘটনাস্থলে এক পুলিশ সদস্য নিহত হন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি রাকিব হাসানকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন তিনি পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।
এ ঘটনা তদন্তে ওই দিনই অতিরিক্ত সচিব নাজিমুদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি কমিটি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কমিটি গত রোববার বিকেলে মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব সি কিউ কে মুসতাকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেয়।
দায়দায়িত্ব: তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ধর্ষ কয়েদিদের স্থানান্তরের জন্য যে ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা দরকার, এ ক্ষেত্রে তা ছিল না। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দায়িত্ব গাজীপুর জেলা পুলিশের। এর আগে এমন বন্দী স্থানান্তরের সময় প্রিজন ভ্যানে পুলিশ সদস্য বেশি ছিল। পাশাপাশি সাত-আটজন সশস্ত্র পুলিশ পৃথক গাড়িতে প্রিজন ভ্যানটিকে পাহারা দিত। কিন্তু এবার এ ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের ময়মনসিংহে পাঠানোর বিষয়টি সেখানকার পুলিশকেও জানানো হয়নি।
বন্দী হস্তান্তরের সময় কারা কর্তৃপক্ষ পুলিশ সুপারকে সোর্সের চাহিদাপত্র পাঠায়। চাহিদাপত্রে আসামির ধরন লেখা ছিল। পুলিশ সুপার রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আরআই) এ কে এম সাইদুল করিমকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সাইদুল করিম ওই দিন কর্মস্থলে ছিলেন না। তাঁর বদলে সশস্ত্র পুলিশ পরিদর্শক ইব্রাহিম খান দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও প্রয়োজনীয় পুলিশ দিতে কমান্ড সার্টিফিকেট (সিসি) দেন। কিন্তু তদন্ত কমিটিকে তিনি বলেছেন, না দেখে ওই দিনের আদেশে সই করেছেন। আবার সাইদুল করিম পুলিশ লাইনে তাঁর বাসায় ছিলেন বলে কমিটিকে জানান ইব্রাহিম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামি নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন এএসআই হাবিব, একই সঙ্গে তিনি কনস্টেবলদের কাজ বণ্টনের দায়িত্বেও ছিলেন। ওই দায়িত্বে থাকা আরেক এএসআই আইয়ুব তাঁকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দিয়েছেন। কমিটি তাঁদের দুজনকেই দায়ী করেছে।
প্রিজন ভ্যানের চালক কনস্টেবল সবুজ মিয়ার আচরণকে সন্দেহজনক বলে উল্লেখ করে কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার সময় তিনি সাদা শার্ট পরে ছিলেন। কিন্তু কমিটির কাছে তিনি ইউনিফর্ম পরা ছিলেন বলে দাবি করেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, ট্রাকের গতিরোধের কোনো প্রমাণই পায়নি কমিটি। এ বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তদন্ত করতে বলেছে কমিটি।
দায়িত্বরত এএসআই হাবিব অস্ত্র চালনায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলেও আক্রান্ত হয়েও তিনি কোনো গুলি ছোড়েননি। এটা রহস্যজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জেলা পুলিশ সুপারের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ফোর্স বণ্টন করার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা আরআই পুলিশ সুপারের নির্দেশেই অন্য কাজে বাইরে ছিলেন। কিন্তু কী কাজে ছিলেন, তা পুলিশ সুপার কমিটিকে জানাননি। অন্যদিকে, তাঁর জেলার অন্তর্গত চারটি কেন্দ্রীয় কারাগারের দুর্ধর্ষ বন্দী স্থানান্তরের বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট মনোযোগ ছিল না। এ ছাড়া অনুপস্থিত কর্মকর্তার পরিবর্তে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সার্বিকভাবে দায়িত্ব পালন না করা পুলিশ সুপারের ব্যর্থতা বলে মনে করে তদন্ত কমিটি।
জেলা পুলিশ সুপারের অধীনে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং সহকারী পুলিশ সুপারসহ অন্য কোনো কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বলে কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে।
তদন্ত কমিটি কাশিমপুর কারাগার, গাজীপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়, ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করে এবং ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জব্দ করা গাড়ি, তালা, পিস্তল, বোমার স্প্লিন্টার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। তদন্তে কমিটি সংশ্লিষ্ট ২৭ জনের জবানবন্দি নেয়।
পর্যবেক্ষণ: কমিটি তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, কয়েদি ছিনতাইয়ের ঘটনাটি একটি দীর্ঘ সমন্বিত পরিকল্পনার ফল। নিয়ম অনুযায়ী কারাগারের ভেতরে মুঠোফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। কারাগারে মুঠোফোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য জ্যামার মেশিন বসানো রয়েছে। কারাবন্দীদের প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় তল্লাশি করা হয়। তাতে কারাগারে মুঠোফোন নেওয়া দুরূহ।
কিন্তু জঙ্গিদের ব্যবহার করা সাদা মাইক্রোবাসে মোবাইল ফোনের একটি ভাঙা সিম পাওয়া গেছে। ওই নম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত গাজীপুর কারাগার থেকে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করা হয়েছে। যেহেতু জঙ্গিরা কারাগারের ভেতরে মুঠোফোন ব্যবহার করেছে, সেহেতু এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে মুঠোফোন ভেতরে নেওয়া হয়েছে। তবে কমিটি বলেছে, এর জন্য কোনো কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা যায়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েদিদের মূল হেফাজতকারী কারারক্ষীরা যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন না। পিআরবি (পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল) অনুযায়ী, গাজীপুর পুলিশের কয়েদি স্থানান্তরের জন্য পুলিশ স্কট দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও এ ক্ষেত্রে তা পালন করা হয়নি। পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও স্বীকার করেছেন, তাঁরা এমন দুর্ধর্ষ কয়েদি স্থানান্তরের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নেননি।
তদন্ত কমিটি জানায়, জঙ্গি ছিনতাইয়ের সময় প্রিজন ভ্যানের পেছনের দরজা খোলা ছিল। এর ফলে অতি সহজেই ভ্যানের পেছনে অবস্থিত পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয় জঙ্গিরা। প্রিজন ভ্যানের কয়েদিদের থাকার জায়গাটি তালাবদ্ধ ছিল না বলে ধারণা করেছে কমিটি। গাড়ির মধ্যে একটি ভাঙা (কর্তন করা) তালা পাওয়া গেছে। তালায় মরিচা পড়া ছিল।
কমিটি জানায়, প্রথমে একটি ট্রাক বাঁ দিক থেকে এসে গতিরোধ করলে প্রিজন ভ্যান চালক কনস্টেবল সবুজ মিয়া ভ্যানটি থামিয়ে ফেলেন। কিন্তু ওখানে রাস্তা এতটাই প্রশস্ত ছিল যে তিনি চেষ্টা করলে ট্রাক অতিক্রম করতে পারেন। প্রিজন ভ্যানচালক জানিয়েছেন, ট্রাকটি গতিরোধ করার সঙ্গে সঙ্গেই সাদা মাইক্রোবাস এসে ভ্যানের সামনে থামে। এরপর তিনি ট্রাকচালকের সঙ্গে বাগিবতণ্ডা করেন। এতে প্রতীয়মান হয়, ট্রাকটির গতিরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোবাস আসেনি।
কমিটি জানায়, গাড়ির চালক সবুজ মিয়াকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা কোনো বোমা নিক্ষেপ বা গুলি করেনি। তাঁর সাদা জামা এবং আহত না হওয়ার বিষয়টি সন্দেহের উদ্রেক করে।
চালকের বাঁ পাশে বসা আর্মড এসআই হাবিবুর রহমানের পিস্তল ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও তিনি করেননি। প্রিজন ভ্যানের উইন্ডশিল্ডে দুটি বুলেটের চিহ্ন অনুযায়ী হাবিবুর রহমানের গাড়ির ভেতরে বসা অবস্থায় তাঁর বুকের ওপরের দিকে বুলেটের আঘাত লাগার কথা। কিন্তু হাবিবের আঘাত পেটে লেগেছে। এটা বুলেট না বোমার স্প্লিন্টার, তা বোঝা যায়নি।
এ ছাড়া কয়েদিদের স্থানান্তরের জন্য গাড়িটি ছিল অত্যন্ত জরাজীর্ণ। নিরাপত্তারক্ষীদের বসার স্থানটি ছিল সংকীর্ণ। এখান থেকে জরুরি প্রয়োজনী মুহূর্তে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব ছিল না।
ফোর্স বণ্টনে নারায়ণগঞ্জে বদলির আদেশপ্রাপ্ত গাজীপুর পুলিশে দায়িত্বরত এসআই হাবিবুর রহমান তাঁর বদলি বাতিলের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু এই কাজে নবনিযুক্ত একজন এএসআই জানান, এএসআই হাবিবুর রহমানই ফোর্স বণ্টন করেছেন।
সুপারিশ: দুর্ধর্ষ আসামি বা কয়েদি হস্তান্তরে দায়িত্ব বণ্টনের বা ফোর্স মোতায়েনের কাজ কমপক্ষে একজন এএসপির অধীনে ন্যস্ত করাসহ ১০ দফা সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কারাগারে মুঠোফোন বন্ধ করার পাশাপাশি কারাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওয়াকিটকি সরবরাহ করা, কয়েদিদের জন্য বিশেষ ধরনের প্রিজন ভ্যানের ব্যবস্থা করা, দুর্ধর্ষ বন্দীদের যত কম সম্ভব স্থানান্তর করার বিষয়ে আইনি বা বিধিবিধান সংশোধন করার সুপারিশ করেছে কমিটি।
কারা কর্তৃপক্ষ বন্দীকে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের সময় প্রয়োজনীয় পুলিশি নিরাপত্তাব্যবস্থা, স্কট প্রদানের ক্ষেত্রে সক্ষম এবং দক্ষ ফোর্স নিয়োগ করা, বন্দী স্থানান্তরের ক্ষেত্রে একাধিক জেলা সংশ্লিষ্ট হলে প্রতি জেলার পুলিশ সুপারকে বন্দী পরিবহনকারী জেলা পুলিশ সুপার কর্তৃক যথাসময়ে অবহিত করা, স্কট সদস্যদের নিজ জেলায় দায়িত্ব না দেওয়া, কারাবিধি অনুযায়ী বন্দীর প্রকৃতি কোর্ট ইন্সপেক্টর কর্তৃক নির্ধারণের প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা এবং কারাগারে মুঠোফোন ট্র্যাকার, লাগেজ স্ক্যানার, পারসনস স্ক্যানার মেশিন স্থাপন করার সুপারিশ করা হয়েছে কমিটির প্রতিবেদনে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য: তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিভাগীয় কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় কারা জড়িত, প্রতিবেদনে তা উল্লেখ আছে। এর মধ্যে যেগুলো যুক্তিসংগত সেগুলো আমলে নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন