নিক্সন-কিসিঞ্জারের পর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনাকে এবার চক্রাšেত্মর শিরোমণি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভারতের আসামের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দৈনিক যুগশঙ্খ’ বৃহস্পতিবার ‘পটভূমি বাংলাদেশ: চক্রাšেত্মর শিরোমণি নিক্সন-কিসিঞ্জার থেকে ড্যান ডব্লিউ মোজেনা’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। লিখেছেন অতীন দাশ।
দৈনিক যুগশঙ্খে প্রকাশিত সম্পাদকীয়টি আমাদের সময় ডটকমের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো:
‘‘প্রতিবেশী বাংলাদেশে দশম সাধারণ নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগসহ চৌদ্দ দলের জোট ক্ষমতাসীন হয়েছে। খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন আঠারো দলীয় জোট নির্বাচন বয়কট করার ফলে সংসদ প্রায় বিরোধীহীন হয়ে রয়েছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হোসেন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এক চরম অস্ব¯িত্মকর পরিবেশে পড়েছে। এরশাদ প্রথমত নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বলেও শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেন। তাকে সামরিক হাসপাতালে প্রায় নজরবন্দি রেখে পতœী রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তেত্রিশটি আসনে বিজয়ী হয়। জাতীয় পার্টি এখন সরকারের অংশ, আবার বিরোধী দলও।
জাতীয় পার্টির সদস্যরা মন্ত্রিসভায় রয়েছেন অথচ বেগম রওশন এরশাদ বিরোধী নেত্রীর মর্যাদা ভোগ করছেন। সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন হলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার মোটেই স্ব¯িত্মতে নেই।
বাংলাদেশে গত বছর খানেক ধরে যে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে বিদেশি শক্তির হাত যে খুব সক্রিয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হতেই গোলমালের সূত্রপাত।
দেশে সংবিধানসম্মত নির্বাচন অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপিসহ আঠারো দলীয় জোট যখন বিরোধ প্রকট করে, নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয় এবং সারা দেশেজুড়ে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- শুরু করে তখন ওইসব বিদেশি দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তাদেরও খুবই সক্রিয় দেখা যায়। তারা বারবার বিরোধীদের সঙ্গে বার্তালাপ শুরু করার জন্যে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।
দেশের সংবিধানে যেখানে নির্বাচন পরিচালনা জন্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তদারকি সরকার গঠনের কোনো সংস্থান নেই- সেখানে কোন ভিত্তিতে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে- বৌদ্ধিক মহলের কাছে সেই প্রশ্নের কোন জবাব নেই।
সংবিধান এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়ার পরও সেই কুটনীতিকরা এখনও মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন এবং বিরোধীদের সঙ্গে শলা-পরামর্শক্রমে নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রফতানিই জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম বুনিয়াদ। নিতাšত্ম রাজনৈতিক কারণেই পশ্চিমের দেশগুলো এর ওপর অযৌক্তি বাধা-নিষেধ চাপিয়ে সংকট সৃষ্টি করতে চাইছে। এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতর বিরোধী ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকি¯ত্মান ভেঙে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করুক- তা তারা চায়নি। এ জন্যে শতাব্দীর সবচেয়ে মানবিক বিপর্যয়েও তথাকথিত মানবাধিকার রক্ষার স্বনিয়োজিত অভিভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করে গেছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকি¯ত্মান সেনাবাহিনী যেদিন পূর্ব পাকি¯ত্মানের নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর হামলা চালায়, ট্যাঙ্ক-মেশিনগান এবং নির্বিচার বোম্বিংয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেদিন নিস্পৃহ, নির্বিকার। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ঘন ঘন টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছেন, ফোনে যোগাযোগ করছেন, কিন্তু মার্কিন সরকার কালা-বধিরের ভূমিকা পালন করে চলে। ব্লাড রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন কীভাবে হিন্দু বসতিগুলো জনশূন্য করে দেয়া হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস গুঁড়িয়ে দিয়ে শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হচ্ছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে পাকি¯ত্মানকে সংযত হওয়ার কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। বরং পাকি¯ত্মানকে অস্ত্র এবং আর্থিক সাহায্য বাড়িয়েই চলেছে।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকি¯ত্মানকে অস্ত্র সাহায্যের ব্যাপারে যে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল- তা লঙ্ঘন কইে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি পাকি¯ত্মানকে ট্যাঙ্ক, জেট ফাইটার, সামরিক পরিবহনের জন্য বিরাট বিরাট এরোপ্লেন, জিপ, কামান এবং বিপুল পরিমাণ গোলা-বারুদ পাঠাতে থাকে। এমনকি জর্ডান এবং ইরানের মাধ্যমে অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান পাঠানো হয় পাকি¯ত্মানে।
ঢাকায় নিযুক্ত কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ছাড়াও নতুন দিল্লি থেকে রাষ্ট্রদূত কেনিথ কিটিং এবং ডেমোক্র্যাট সিনেটর এ্যাডওয়ার্ড কেনেডি পূর্ব বাংলায় মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের এই ভূমিকার কড়া সমালোচনা করলেও রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন এবং বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জার তাদের সিদ্ধাšেত্ম অনড় থাকেন।
মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও পাকি¯ত্মানের সামরিক একনায়ক জেনারেল আগা মুহম্মদ ইয়াহিয়া খান তাদের পছন্দের লোক এবং প্রিয় পাত্র, নিক্সন সনের কাছে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তার মতে- পিতা জওহরলাল নেহেরুর মতো ইন্দিরাও বাজে লোক। ভারত এবং ভারতীয়রা তার চোখে ঘৃণ্য।
পাকি¯ত্মানকে দুর্বল করে ভারত দক্ষিণ এশিয়া শক্তিশালী হয়ে উঠুক- সেটা তাদের কাম্য নয়। এই সময়ই পাকি¯ত্মানের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হয়। কিসিঞ্জার গোপনে পাকি¯ত্মান থেকে বেইজিংয়ে উড়ে যায়- মাও সে তুঙ সহ চীনা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে।
নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি চীনকে অনুরোধ জানায় ভারত সীমাšেত্ম সৈন্য সমাবেশের জন্য যাতে মিত্র পাকি¯ত্মানের পক্ষে পরিস্থিতি অনুকূল হয়। এমনকি ভারতকে ভয় দেখানোর জন্য মার্কিন সপ্তম নৌবহরও ভারত মহাসাগরের দিকে এগোতে থাকে। ইত্যবসরে ভারত সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাক-ভারত সংকটকে আর ঘোরালো করতে চায়নি।
ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চক্রাšত্ম থেমে থাকেনি। তারা বুঝতে পারে ল্যাটিন আমেরিকায় কিউবার মতো দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশও হবে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী। কারণ বাংলাদেশই প্রথম রাষ্ট্র যে মার্কিন প্রভাব বলয়কে উপেক্ষা করে দক্ষিন ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লব সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে বাংলাদেশে তাদের মিশন খোলার অনুমতি দেয়। বঙ্গবন্ধু পিএলও কে ঢাকায় মিশন খোলার অনুমতি প্রদান করেন এবং কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন করেন।
আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে তীব্র আক্রমণ শানান তাতে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি বুঝতে পারেন শেখ মুজিবুর রহমানকে যেনতেন প্রকারে সরিয়ে দিতে হবে। শেখ মুজিব জীবিত থাকলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন নীতি জোর প্রত্যাহ্বানের সম্মুখীন হবে।
এরপরই শুরু হয় সিআই-এর অভিযান। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি ফিলিপ চেরী বাংলাদেশে সিআই-এর চিফ হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। বাংলাদেশের সিআই-এর পরীক্ষিত বন্ধু ব্যুরোক্রেট মাহবুব আলী চাষীর মাধ্যমে তাদের নীল নকশার কাজ শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো শেখ মুজিবকে উৎখাত করে তাদের পছন্দের খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ক্ষমতায় বসানো। মাহবুব আলী চাষী মুজিব নগর সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের অধীনে কাজ করতেন। সিআই-এর সঙ্গে তার যোগসাজশ প্রমাণ হয়ে পড়লে প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন তাকে অপসারণ করেছিলেন।
চাষী প্রথমেই উচ্চাকাক্সক্ষী জিয়া এবং মোশতাক আহমেদের ভাগিনা মেজর রশিদকে হাত করে নেন। রশিদের ভায়রা মেজর ফারুক রহমানও অচিরেই দলে ভিড়ে যান। কিসিঞ্জার তার বিশেষ আস্থাভাজন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি হ্যারল্ড স্ট্যান্ডার্সকে কলকাতায় পাঠান। স্যান্ডার্সের ঘনিষ্ঠ জর্জ গ্রিফিন তখন কলকাতার কনস্যুলেটের দায়িত্বে। গ্রিফিনকে বাংলাদেশ সম্পর্কে অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং মোশতাক গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়। সিআই-এর নেটওয়ার্ক পুরোদমে কাজ শুরু করে দেয়।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল কলকাতা সফরে আসে। ওরা জর্জ গ্রিফিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই দলের অন্যতম সদস্য মেজর শরিফুল হক ডালিম একদিন তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যেই বলে ফেলেন, ‘এ মাসেই আর্মি ক্যু হবে’। এর পরের ঘটনা তো বাঙালি জাতির জন্য এক কলঙ্কিত ইতিহাস।
আমেরিকা আজও বসে নেই। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনাকে তারা কোন অবস্থাতেই বরদা¯ত্ম করতে পারে না। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসার দু মাসের মধ্যেই বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে তাকে উৎখাত করার চেষ্টা হয়েছিল। তার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে অনেক বার। যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল, যে পাকি¯ত্মানপন্থীরা বিএনপির মূল শক্তি, তারাই চাইছে বাংলাদেশকে আরেক পাকি¯ত্মান হিসেবে গড়ে তুলতে।
ধর্ম নিরপেক্ষতা তারা সহ্য করতে পারে না। তাই সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-উৎপীড়নের মাধ্যমে দেশকে হিন্দুশূন্য করে তুলতে ওরা ওঠে পড়ে লেগেছে। বঙ্গবন্ধু তনয়া তথা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ে তুলতে চায়। একাত্তরে যারা ঘাতক দালাল, মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত, তাদের উপযুক্ত শা¯িত্ম বিধানে প্রয়াস নিয়েছে এই সরকার। বিএনপি জামায়াত এই প্রয়াসকে অব্যাহত করতে চায় না। তাই ওরা দেশজুড়ে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে এক অরাজকতার সৃষ্টি করতে চাইছে। এর মদত দিচ্ছে বিদেশি কিছু কূটনীতিক মিশন। সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি এবং বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সঙ্গে ঘন ঘন শলা-পরামর্শ করতে যেসব কূটনীতিক সদা সক্রিয় দেখা যায়- তাদের অগ্রে রয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিই মোজেনা।
উৎসঃ আমাদের সময়