উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ‘খারাপ ফল’ দেখে দ্বিতীয় ধাপের প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এবার বিদ্রোহী প্রার্থীদের বশে এনে সাংগঠনিক ঐক্য জোরদার করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মন্ত্রী-সাংসদদের হস্তক্ষেপ বন্ধেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও দল ভালো ফল করতে পারেনি বলে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা আছে। এ জন্য প্রার্থী সমর্থনের নামে স্থানীয় সাংসদ, মন্ত্রী ও কিছু বড় নেতার অযাচিত হস্তক্ষেপকে দায়ী করা হচ্ছে।
দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের প্রার্থী সমর্থনের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় সাংসদদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে থেকে দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতি-মণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সাংগঠনিক সম্পাদকেরা এলাকায় যাচ্ছেন। তাঁদের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে।
১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম দফা ভোট গ্রহণের পর ২৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় ধাপে ১১৭টি উপজেলায় ভোট হবে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা স্বীকার করেন, মন্ত্রী ও সাংসদের হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে উপজেলা নির্বাচনে দল ভালো ফলাফল পাবে না। বেশির ভাগ এলাকায় মন্ত্রী-সাংসদদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখতেই দল-সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবি হচ্ছে। তাঁদের ইন্ধনে কোথাও দল-সমর্থিত প্রার্থীর বিপক্ষে আবার কোথাও বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেওয়ায় সাংগঠনিক ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ জন্য দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সংশ্লিষ্ট সাংগঠনিক সম্পাদকদের বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণে এনে সাংগঠনিক ঐক্য জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথম ধাপের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ভুল-ত্রুটি শোধরানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের সামলিয়ে দল-সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে পরিপূর্ণ দলীয় শক্তি নিয়ে মাঠে নামার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা নির্বাচনসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকটি বিভাগীয় সাংগঠনিক দলের সঙ্গেও কথা বলেছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রথম আলোকে বলেন, তৃণমূলের নেতারা মন্ত্রী-সাংসদদের কথায় চলাফেরা করেন। মন্ত্রী-সাংসদেরা নিজেদের স্বার্থে নানা বলয় তৈরি করে রাখেন। ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকেরা কিছু করতে পারছেন না। তাঁদের কথায় স্থানীয় নেতারা অতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলা নির্বাচনে খারাপ ফলাফলের জন্য সাংগঠনিক অনৈক্যের পাশাপাশি দলীয় স্থানীয় নেতাদের বাড়াবাড়িকেও দায়ী করা হচ্ছে। স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করারও অভিযোগ আছে। বিশেষ করে, গত নির্বাচনের আগে আন্দোলনের সময় সহিংসতার দায়ে অনেক নিরীহ-নিরপরাধ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেককে থানা-পুলিশের ভয় দেখিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। এসব কারণেও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন।
কয়েকজন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা সাংসদ এবং জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের প্রভাব বেশি। সাংগঠনিক সম্পাদকেরা চেষ্টা করলেও তাঁদের সহায়তা না পেলে ইতিবাচক ফল আসবে না। ফলে সবগুলো সাংগঠনিক দলের পক্ষ থেকে জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে দলীয় ঐক্য জোরদার করার বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিভাগে ২৫টি উপজেলায় ভোট হবে। এখনো অর্ধেক উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বুঝাচ্ছি। শেষ অস্ত্র হিসেবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলছি। এর বাইরে তো আমাদের আর কিছু করার নেই।’
রংপুর বিভাগের ১৬টি উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জেলা ও উপজেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় নেতাদের ওপর তাঁদের প্রভাব বেশি।
রাজশাহী বিভাগে ২২টি উপজেলায় নির্বাচন হবে। এর মধ্যে ১৮টি উপজেলায় আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী আছেন। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদের মতে, দল পুরো শক্তি নিয়ে মাঠে থাকলে এ বিভাগে এবার ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হবে।
খুলনা বিভাগে ১২টি এবং সিলেট বিভাগে চারটি উপজেলায় নির্বাচন। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক এবং মিজবাহউদ্দিন সিরাজের আশা, এ দুই বিভাগের অর্ধেক উপজেলায় দল-সমর্থিত প্রার্থী জিতবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সাংগঠনিক সম্পাদক জানিয়েছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে তাঁদের ওপর চাপ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের কিছু করার থাকে না। এলাকায় দলের ওপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সাংসদের প্রভাব থাকে। তাঁরা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে দল-সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব। সাংগঠনিক সম্পাদকেরা মনে করেন, মন্ত্রী-সাংসদদের বাইরে গিয়ে কিছু করা কঠিন।