ঢাবি’র ভর্তি পরীক্ষায় ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য

0
190
Print Friendly, PDF & Email

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় গত তিন বছরে গড়ে ৮০ শতাংশেরও বেশি পরীক্ষার্থী ন্যূনতম পাস নম্বরও পাননি। মাত্র ২০ শতাংশ বা এর চেয়েও কমসংখ্যক শিক্ষার্থী ন্যূনতম পাস নম্বর অর্জনে সক্ষম হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রতি বছর পরীক্ষার্থীদের রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। এরপরও ন্যূনতম নম্বর না পেয়ে অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, এটা খুবই আশংকাজনক। বিষয়টি উদ্বেগজনক এই কারণে যে, এই পরীক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সারা দেশ থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল করেন। দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী মনে করা হয় তাদের। এর অর্থ দাঁড়ায়, দেশের সর্বোচ্চ ফলাফলের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মেধাবী এই শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।

২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী মোট দুই লাখ ১৭ হাজার ২৪৭ জন। এর মধ্যে অকৃতকার্য হয়েছেন এক লাখ ৭৫ হাজার ৩৪৬ জন পরীক্ষার্থী, যা মোট সংখ্যার প্রায় ৮১%। অর্থাৎ এই ৮১ শতাংশ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার জন্য ন্যূনতম নম্বরটিও পাননি। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে এই হার ছিল ৮৩ শতাংশ এবং ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ছিল ৮১ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর মোট পাঁচটি ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়- বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ক’ ইউনিট, মানবিক বা আর্টস অনুষদভুক্ত ‘খ’ ইউনিট, বাণিজ্য অনুষদভুক্ত ‘গ’ ইউনিট, নির্বাচিত কয়েকটি বিশেষ বিভাগে সব ধরনের অনুষদের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিষয় পরিবর্তন পরীক্ষার জন্য ‘ঘ’ ইউনিট এবং চারুকলা অনুষদের জন্য ‘চ’ ইউনিট।

পাঁচটি ইউনিটেই ভর্তি পরীক্ষা হয় মোট ১২০ নম্বরে, যার মধ্যে ন্যূনতম পাশ নম্বর হলো ৪০ বা ৪৪ নম্বর। এর মধ্যে ‘খ’, ‘গ’ ও ‘ঘ’ ইউনিটের শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞানের মতো নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পৃথকভাবে ন্যূনতম পাস নম্বর পেতে হয়।

২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন চারুকলা অনুষদভুক্ত ‘চ’ ইউনিটে। এছাড়া বাণিজ্য অনুষদভুক্ত ‘গ’ ইউনিটে ৯১ শতাংশ, মানবিক অনুষদভুক্ত ‘খ’ ইউনিটে ৮৬ শতাংশ এবং বিষয় পরিবর্তনের জন্য ‘ঘ’ ইউনিটে প্রায় ৯১ শতাংশ পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন। আর বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক কম, ৫৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী এই অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি।

প্রশাসন বলছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তো বটেই, এছাড়া প্রতি বছর সারা দেশে সবচাইতে ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীরা এই ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। আর এই শিক্ষার্থীদেরই এত বড় একটি অংশ যখন ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর পেয়ে কৃতকার্যই হতে পারেন না, তখন বোঝা যায় দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান কতটা খারাপ। ভর্তি পরীক্ষার এই ফলাফল স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষার ক্রমহ্রাসমান মানেরই প্রতিফলন মাত্র।

মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সবচাইতে মেধাবীদের বাছাই করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি পরীক্ষাকে ‘ফিল্টারিং পদ্ধতি’ হিসেবে ব্যবহার করে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সমন্বয়ক অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেন বলেন, “মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীরা যখন ন্যূনতম নম্বর পেয়ে কৃতকার্যও হতে পারে না, তখন তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়।”

গত তিন বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সারা দেশ থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল করা অর্থা জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদেরই একটি বিশাল অংশ ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে।

২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক- উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া ৬৭ হাজার ৫৮ জন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ৫৬.১২% পরীক্ষার্থী ন্যূনতম পাস নম্বর পেয়ে কৃতকার্য হতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১১-১২ এবং ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে এই হার ছিল যথাক্রমে ৫৫% এবং ৫২%।

বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “প্রতি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়ছে। কিন্তু জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের পরিমাণ বাড়লেও তাদের অর্জিত শিক্ষার মান যে আসলে কতটা দুর্বল তা প্রমাণিত হয় ভর্তি পরীক্ষায় তাদের অবস্থা দেখলে।”

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য সারা দেশে নন্দিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জু আরা বেগম জানান, ভালো ফলাফলের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান যে বাড়ছে না, তা সন্দেহাতীত। তিনি বলেন, “মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা, কোনোরকমে একটা ভালো গ্রেড পাওয়া এখন খুবই সহজ। অধিকাংশ শিক্ষার্থী এই পর্যায়ে এসেও বাছাইকৃত কিছু বিষয়ের ওপর সামান্য পড়াশোনা করে। কোনো বিষয়ে স্পষ্ট ও গভীর জ্ঞান অর্জন না করেই ভালো ফলাফল করতে পারলেও যখন তারা কোনো প্রযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তখনই আর কৃতকার্য হতে পারে না তারা।

শেয়ার করুন