বিজ্ঞাপন দিয়েও ঋণগ্রহীতা পাচ্ছে না ব্যাংক

0
221
Print Friendly, PDF & Email

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দেশের দুর্বল অবকাঠামোয় বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। অস্থিরতা না কাটায় শিল্প উদ্যোক্তাসহ ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এতে চরম সঙ্কটের মুখে পড়েছে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। আশঙ্কাজনক হারে প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং সেক্টরের বিনিয়োগ কার্যক্রমে। উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ। তাই ঋণগ্রহীতা পাওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। তবে বিজ্ঞাপন দিয়েও বিনিয়োগকারী পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ দেশের সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঋণগ্রহীতা পেতে বিজ্ঞাপনেরও প্রয়োজন হতো না বলে মনে করেন অর্থনীতি গবেষকরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, দেড়-দুই বছর আগেও ব্যাংকে নগদ অর্থের হাহাকার ছিল। সে সময়ে ১৫-১৬ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহ করতে পারেনি অনেক ব্যাংক। টাকার অভাবে ব্যাংকের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে অনেকে দ্বারস্থ হয়েছিল উচ্চ সুদের কলমানি মার্কেটে। অথচ বর্তমানে ব্যাংকগুলো তাদের প্রয়োজনীয় তারল্য সংরক্ষণের পরও ব্যাংকিং খাতে বড় অংকের তারল্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। যা এখন ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা অর্থ বিনিয়োগ না করেও আমানতকারীদের নির্ধারিত সুদ দিতে হচ্ছে। যা ব্যাংকের মুনাফায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাই বিনিয়োগকারীদের ঋণগ্রহণে আগ্রহী করতে বাধ্য হয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে ব্যাংকগুলোকে। তবে বিজ্ঞাপন দিয়েও উল্লেখযোগ্য হারে ঋণগ্রহীতা পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হবে ততোক্ষণ বিনিয়োগের প্রতি ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরে আসবে না বলে অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত ২০ বছরের মধ্যে বর্তমানে বিনিয়োগের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা চলছে। বিনিয়োগের খাত না পেয়ে কোনোরকমে টিকে থাকতে ব্যাংকগুলো সরকারের ট্রেজারি বণ্ডে টাকা খাটাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনীয় তারল্য সংরক্ষণের পরও ব্যাংকিং খাতে মোট ৯৫ হাজার ৫৮০ কোটি ৭১ লাখ টাকা অলস পড়ে আছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর কাছে রয়েছে ৪১ হাজার ২০৭ কোটি ২১ লাখ, রাষ্ট্রীয় খাতের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে এক হাজার ৬১১ কোটি ৯৪ লাখ, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ৪৩ হাজার ৬৬৩ কোটি ৫৬ লাখ এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোতে ৯ হাজার ৯৮ কোটি এক লাখ টাকার তারল্য।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় খাতের সোনালী ব্যাংকে ২০ হাজার ৯০ কোটি, জনতা ব্যাংকে ১১ হাজার ৬২ কোটি ৬২ লাখ, অগ্রণী ব্যাংকে ৯ হাজার ৪১ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকে এক হাজার ১৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকার তারল্য পড়ে রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, নভেম্বর ১৩ শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। যা এর আগের বছরের একই মাসে ছিল ১৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। আর মুদ্রানীতিতে এ মাসের প্রক্ষেপণ ছিল ১৬ শতাংশ।

একাধিক ব্যাংকার জানিয়েছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন কোনো উদ্যোক্তা বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না। পূর্বে যাদের বিনিয়োগ রয়েছে তারাও সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছেন। সোনালী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও ঋণগ্রহীতা পাচ্ছে না। ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় অতিরিক্ত তারল্য নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে ব্যাংকগুলো। কাঙ্খিত ঋণ বিতরণ না হওয়ায় অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা কমে গেছে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিচার্স ইন্সটিটিউট-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. আহসান এইচ মুনসুর শীর্ষ কাগজকে বলেন, বিজ্ঞাপন দিয়ে বিনিয়োগকারী পাওয়া যায় না। বস্তুত এতে কোনো লাভ হয় না। সুদের হার কম দেখিয়ে ঋণগ্রহীতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বা জোর করে বিনিয়োগের ওপর মনোভাব ফিরিয়ে আনা ঠিক নয়।

তিনি বলেন, যখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে, অর্থনীতির সম্ভাবনা ফিরে আসবে তখন এমনিতেই বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকে আসবে ঋণের জন্য।

সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল প্রধান শাখার মহাব্যবস্থাপক মো: শওকত আলী বলেন, আমরা বিজ্ঞাপন দিয়ে ঋণগ্রহীতাদের সাড়া পেয়েছি। ইতিমধ্যে অনেক ব্যবসায়ীর ঋণগ্রহণের আবেদনপত্র পেয়েছি। যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে। শিগগিরই বিনিয়োগকারীদেরকে ঋণ দেওয়া শুরু হবে।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, সাধারণত ব্যাংকগুলো নতুন কোনো সেবা নিয়ে আসলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু ঋণগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সোনালী ব্যাংক কেন বিজ্ঞাপন দিয়েছে তা জানি না। কারণ, ঋণগ্রহণে বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কোনো লাভ হয় না।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনীয় তারল্য সংরক্ষণের পরও প্রচুর তারল্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। তাই বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে বেশি সাড়া পাওয়া যাবে এটা ভাবা ঠিক নয়। বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজন হলে তারা ঋণগ্রহণের জন্য আবেদন করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ডিসেম্বর শেষে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে ঋণ বেড়েছে মাত্র সাত দশমিক ৪১ শতাংশ। আর আমানত বেড়েছে ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। বিনিয়োগের চাহিদা না থাকায় বেশ কিছু দিন ধরেই ঋণ প্রবাহ কমছে। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৬৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। এ সময়ে আমানত রয়েছে ছয় লাখ ২৭ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এতে করে ঋণ আমানতের অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৭১ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর আগের বছর শেষে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশের ওপরে ছিল। ২০১৩ সালের জুন শেষে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছিল আট দশমিক ৯৭ শতাংশে। তখন আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর ১৭ অক্টোবর শেষে ব্যাংকগুলোর কাছে সামগ্রিকভাবে পাঁচ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা ছিল। এর মধ্যে এক লাখ ৭৯ হাজার ৫২২ কোটি টাকা নগদ রয়েছে। সে হিসাবে ব্যাংকিং খাতে মোট অর্থের ৩০ দশমিক ৮৮ শতাংশ তারল্য বা অলস। ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৭৯ হাজার ৬৬৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সে হিসাবে আড়াই মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে ১৫ হাজার ৯১৭ কোটি টাকার তারল্য বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সুদ হারের ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহারের পর ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলার স্বার্থে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চলতি মূলধন ও মেয়াদি আমানতের ওপর যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তবে ঋণ বিতরণ কমে যাওয়ায় ব্যাংকের কাছে নগদ অর্থের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। এতে মেয়াদি আমানতের ওপর বর্তমানে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে সুদ দেওয়া হচ্ছে।

ব্যাংকারদের মতে, ব্যাংকগুলো সবসময় উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী থাকে। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটে আশঙ্কাজনকভাবে বিনিয়োগ কমে গেছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ কয়েকটি বড় জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশের পর ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে। এতে ব্যাংকের মুনাফা কমে যাওয়ায় এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

উল্লেখ্য, ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগকারীদের নিতে উৎসাহ দিতে গত ১/২ মাস ধরে সোনালী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।

শেয়ার করুন