উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের ৩২ দুর্গে বিএনপি জামায়াতের হানা

0
115
Print Friendly, PDF & Email

সদ্যসমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৩২ দুর্গে হানা দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এককভাবে বিএনপি ২৫ আর জামায়াত ৭টিতে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে চেয়ারম্যান পদ ছিনিয়ে নেয়। এ ছাড়া পুরুষ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন দলকে ধরাশায়ী করেন বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা। প্রথম ধাপের ৯৬ উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল চেয়ারম্যান পদ পায় ৩৪টি।

এর আগে ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা এই ৯৬টির ৬৬টিতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই সময় চেয়ারম্যান পদে বিএনপি মাত্র ১৪টি, জামায়াত ৮টি ও জাতীয় পার্টি ৩টিতে বিজয়ী হয়। সদ্যসমাপ্ত প্রথম ধাপের নির্বাচনে বিএনপি ৪৩, আওয়ামী লীগ ৩৪, জামায়াত ১২ ও জাতীয় পার্টি ১টি উপজেলায় বিজয়ী হয়। অবশ্য এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগও বিএনপি-জামায়াতের কয়েকটি দুর্গে হানা দেয়। প্রথম ধাপের ৯৬ উপজেলার ফলাফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।মানিকগঞ্জে ৭টি উপজেলার প্রথম ধাপে ৪টিতে নির্বাচন হয়। গত নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৪টিতে সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত। এবার তার উল্টো চিত্র। সব কটিতেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হন। গেল উপজেলা নির্বাচনে সাটুরিয়ায় চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের আবদুল মজিদ ফটো। এবার হয়েছেন বিএনপির বসির উদ্দিন ঠাণ্ডু। সিংগাইরে চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের মুশফিকুর রহমান হান্নান। এবার হয়েছেন বিএনপি আবিদুর রহমান রোমান। শিবালয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থিত আবদুর রহীম খান। এবার হয়েছেন বিএনপির আলী আকবর। এ ছাড়া দৌলতপুরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুল কাদের। এবার হয়েছেন বিএনপির তোজাম্মেল হক তোজা।

গোপালগঞ্জের দুটি উপজেলা কাশিয়ানী ও মুকসুদপুরে গতবার আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। এবার হয়েছে তার উল্টো। দুটি উপজেলায় নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসা প্রার্থী। কাশিয়ানীতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুই প্রার্থী সুব্রত ঠাকুর ও মোক্তার মিয়া হেরে গেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জানে আলম বিরু নির্বাচিত হলেও তার মূল রাজনৈতিক পরিচয় বিএনপি ঘরানার। তিনি কাশিয়ানী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যুবদলের সাবেক সভাপতি ছিলেন। কাশিয়ানী বিএনপি তাকেই সমর্থন দিয়েছিল। অন্যদিকে, মুকসুদপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হলেও তিনি ছিলেন বিএনপি সমর্থিত। আগের উপজেলা নির্বাচনে তিনি বিএনপি থেকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার বাবা দুবার বিএনপি থেকে এমপি প্রার্থী হন।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের আসন চট্টগ্রামের মিরসরাই ও হাটহাজারী উপজেলায় চেয়ারম্যানসহ তিনটি পদের একটিও পায়নি ক্ষমতাসীন দল। দুটি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এর আগে এ দুটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। অভ্যন্তরীণ কোন্দলই পরাজয়ের মূল কারণ বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

জামালপুর সদর ও সরিষাবাড়ী দুটো উপজেলায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হন। এর আগে দুটোতেই চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা। সদরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজনকুমার চন্দ্রের পরাজয়ের কারণ হিসেবে দলীয় কোন্দলকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা। সাবেক ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার পছন্দের প্রার্থী হলেও তৃণমূল আওয়ামী লীগের কাছে বিজনকুমার চন্দ্রের জনপ্রিয়তা ছিল শূন্যের কোঠায়। সেখানে আওয়ামী লীগের আরও একজন প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু হীরা তাদের মধ্যে সমঝোতা করতে ব্যর্থ হন। বগুড়ার ধুনট ও সারিয়াকান্দিতে চেয়ারম্যানসহ তিনটি পদই ছিল আওয়ামী লীগের। এবার দুটোতেই চেয়ারম্যান পদে বিএনপি সমর্থকরা নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) পদে দুটোতে জামায়াত প্রার্থী বিজয়ী হন।

সিলেটেরে বিশ্বনাথে এবার চেয়ারম্যানসহ তিনটি পদেই বিএনপি সমর্থিতরা নির্বাচিত হন। এর আগে চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত। জকিগঞ্জে চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি ও দুটি ভাইস চেয়ারম্যানের পদ আওয়ামী লীগের থাকলেও এবার তিনটি পদে বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিতরা বিজয়ী হন। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের সংসদীয় এলাকা নাটোরের সিংড়ায় চেয়ারম্যান ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির মিজানুর রহমান। এবার বিজয়ী হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শফিকুর রহমানের ব্যাপক ভরাডুবি হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন জাহিদুর রহমান ভোলা। প্রতিমন্ত্রী তাকে সমঝোতায় নিয়ে আসতে পারেননি। ফলে ভোলার কর্মী-সমর্থকরা পলকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাই অনেকটা সহজ জয় পান বিএনপির প্রার্থী।

আওয়ামী লীগের ৭ উপজেলায় জামায়াতের হানা : চেয়ারম্যান পদে থাকা আওয়ামী লীগের ৭ উপজেলায় জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে চেয়ারম্যানসহ তিনটি পদেই বিজয়ী হয়েছে জামায়াত। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন তাজুল ইসলাম, ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) মোয়াবিয়া হোসেন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নাজমা খাতুন। আগেরবার তিনটি পদেই ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা। রংপুরের মিঠাপুকুরে চেয়ারম্যান পদে গোলাম রব্বানী, ভাইস চেয়ারম্যান পদে (পুরুষ) আবদুল বাসেত মারজান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মোর্শেদা বেগম নির্বাচিত হন। আগেরবার তিনটি পদেই আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা নির্বাচিত হন।

এটা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান এমপির নির্বাচনী এলাকা। উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মোতাহার আলী বলেন, ছয় বছর ধরে এমপি রয়েছেন আশিকুর রহমান। উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন জাকির হোসেন। তিনি ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। কিন্তু এমপি কোনো ব্যবস্থা নেননি। উপজেলা ‘জাকির লীগে’ পরিণত হয়। তৃণমূলের সমর্থন না নিয়ে এমপি আশিক নিজের পছন্দের প্রার্থী জাকিরকেই আবারও চেয়ারম্যান পদে সমর্থন দেন। ফলে নেতা-কর্মীরা মুখ ফিরিয়ে নেন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় এমপি হয়েও এলাকার কোনো উন্নয়ন না করে শুধু নিজের আখের গুছিয়েছেন আশিক। যে কারণে জামায়াত এ এলাকায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্বাচনী এলাকা সিলেটের গোলাপগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইকবাল আহমেদের ভরাডুবি হয়েছে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী হাজিব নাজমুল ইসলামের কাছে। এর আগে তিনটি পদেই ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা। সেখানে ভাইস চেয়ারম্যান পুরুষ ও মহিলা পদে বিএনপি সমর্থিতরা নির্বাচিত হন। এ আসনে আওয়ামী লীগের দুজন বিদ্রোহী প্রার্থীও ছিলেন। মন্ত্রী তাদের সমঝোতায় নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছেন। যে কারণে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর জয় নিশ্চিত হয়েছে।

পাবনার সাঁথিয়ায় জামায়াত সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মোখলেসুর রহমানের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয় হয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এমপি সমর্থিত প্রার্থী মঞ্জুরুল এলাহীর। এর আগে সেখানে তিনটি পদেই আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন, ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার, দুঃশাসন ও পরিবারতন্ত্রের কারণে টুকুকে লালকার্ড দিয়েছেন সর্বস্তরের ভোটার।

পাবনার আটঘরিয়ায়ও এবার জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী জহুরুল ইসলাম নির্বাচিত হন। এটা ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমানের নির্বাচনী এলাকা। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন তার ছেলে। এলাকার নেতা-কর্মীদের জনপ্রিয়তার বাইরে গিয়ে আত্দীয়করণের কারণে নিজের ছেলেকে প্রার্থী করেন। এ ছাড়া সেখানে দলীয় কোন্দলও ছিল চরমে। বগুড়ার নন্দীগ্রামে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী নূরুল ইসলাম মণ্ডল ও শেরপুরে দবিবুর রহমান নির্বাচিত হন। এর আগে নন্দীগ্রাম ও শেরপুরে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা ছিলেন। খুলনার কয়রায় জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী আ খ ম তমিজউদ্দিন বিজয়ী হন। এ ছাড়া মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানও জামায়াত সমর্থিত। এর আগে সেখানে চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত। এদিকে নীলফামারীর ডিমলায় পুরুষ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াত সমর্থিতরা নির্বাচিত হন। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতেও ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) নির্বাচিত হন জামায়াতের। অন্য দুটি পদে নির্বাচিত হন বিএনপি সমর্থিতরা।

শেয়ার করুন