দুবছরের কষ্টে লালিত স্বপ্ন দুদিনেই ভেস্তে গেল

0
113
Print Friendly, PDF & Email

দুবছরের লালিত স্বপ্ন আর কঠোর পরিশ্রম দুদিনেই ভেস্তে গেল। অনেক টাকা আর রাজধানীতে একটি বাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন ছিল হাবিব ওরফে সোহেলের। যার আসল নাম ইউসুফ মুন্সী। চুরি করে ধরা পড়ে এখন বুঝছেন, অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে জীবনে। সুড়ঙ্গ খুঁড়তে তার অনেক কষ্ট হয়েছে। অনেক ভয়ও লেগেছে, যদি ভেঙে পড়ে তাহলে তো জীবনটাই চলে যাবে।

এমন আরো অনেক কথা, অনেক গল্প পুলিশকে শোনাচ্ছেন কিশোরগঞ্জের সোনালী ব্যাংক থেকে সাড়ে ১৬ কোটি টাকা চুরি করে ধরা পড়া সোহেল। সাত দিনের রিমান্ডে থাকা সোহেল পুলিশকে জানান, তিন বছর দুবাইতে ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ কাজ করার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চেয়েছিলেন কোটিপতি হতে। চুরির ঘটনার পর থেকে ১৯টি সিমকার্ড ও ৯টি মোবাইল ফোনসেট পরিবর্তন করেও শেষ রক্ষা হয়নি তার।

কে এই হাবিব ওরফে সোহেল? কারা তার আশ্রয়-প্রশয়দাতা? কী ছিল তার পরিকল্পনা? এসব অনুসন্ধানে জড়িত এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সোহেল তার ছদ্মনাম। আসল নাম ইউসুফ মুন্সী (৩৭)। তার সহযোগী ইদ্রিস ওরফে মোতাহারের আসল নাম ইদ্রিস মুন্সী (৩০)। সহোদর তারা। বাবার নাম সিরাজ মুন্সী। মায়ের নাম সুফিয়া। বাড়ি পটুয়াখালীর বদরপুর ইউনিয়নের গাবুয়া গ্রামে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ইউসুফ ওরফে সোহেল। ২০০০ সালে পাশের পাংগাশিয়া গ্রামে বিয়ে করলেও স্ত্রী ও দুই সন্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিন তার কোনো যোগাযোগ নেই।

সোহেল ঢাকার শ্যামপুরে ‘পলি ক্যাবল’ নামের একটি কোম্পানিতে ১৫ বছর শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০০৮ সালে চলে যান দুবাইয়ে। দুবাই থেকে ফিরে আসেন ২০১১ সালে। সঙ্গে নিয়ে আসেন উপার্জিত ৭ লাখ টাকা। ফিরে এসে ২ লাখ টাকা ধার শোধ করতে হয় তাকে। কিন্তু সঙ্গদোষে বাকি টাকাও সোহেল বিভিন্নভাবে নষ্ট করে ফেলে।

কিশোরঞ্জে পাড়ি জমানোর নেপথ্যে : মোবাইল ফোনের ক্রস কানেকশনের সূত্র ধরে সোহেলের সঙ্গে পরিচয় হয় কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার চণ্ডীপাশার চিলাকাড়া গ্রামের হেলাল উদ্দিনের কলেজপড়ুয়া মেয়ে হিমা আক্তার মাহিমার সঙ্গে। মাহিমা শহরের ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজের স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ছদ্মবেশী সোহেলের সঙ্গে মাহিমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ককের কারণে সোহেল প্রায়ই কিশোরগঞ্জ চলে আসতেন। একপর্যায়ে পরিবারের অগোচরে মাহিমার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ের পর কিশোরগঞ্জ শহরের নগুয়া এলাকার ভাড়া বাসায় স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস শুরু করেন তারা। তবে সোহেলের বাবা-মা কে, বাড়ি কোথায়, বিস্তারিত কিছুই জানতেন না মাহিমার বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজন । তবে হাতে কোনো কাজকর্ম না থাকায় কিশোরগঞ্জ শহরেই ডিশ কেব্‌ল লাইন সারানোর কাজ বেছে নেন হাবিব।

কে তার বুদ্ধিদাতা : র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হাবিব জানান, দুবাই থেকে ফিরে আসার পর মামাশ্বশুর সিরাজ তার কাছ থেকে ৪ লাখ ধার নেন। কিন্তু প্রয়োজনে টাকা চাইলে টালবাহানা শুরু করেন। কিছুদিন পর তার মামাশ্বশুর সিরাজ তাকে গাজীপুরের আনোয়ার ইস্পাত কারখানায় ফোরম্যান হিসেবে কাজ নিয়ে দেন।

সোহেল বলেন, ‘দুবাই থাকতেই আমি এমন একটা পরিকল্পনা করি- সে কথা বলার পর একদিন কথা প্রসঙ্গে মামাশ্বশুর আমাকে জানান, কিশোরগঞ্জের সোনালী ব্যাংকে অনেক টাকা থাকে।’ এই ধারণা পেয়েই সোহেল অভিনব এবং দুঃসাহসিক চুরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন।

কে এই সিরাজ : সোহেলের স্ত্রী মাহিমার সৎ মামা এই সিরাজ। পুরো নাম সিরাজ উদ্দিন ভূঁইয়া। জেলার হোসেনপুর উপজেলার পুমদী ইউনিয়নের উত্তর চরপুমদী গ্রামের মৃত লুৎফর রহমান ভূঁইয়া ওরফে রব ভূঁইয়ার প্রথম পক্ষের ছেলে তিনি। সিরাজ বিয়ে করেছেন তিনটি। তার প্রথম স্ত্রী চট্টগ্রামে এবং দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তাদের সঙ্গে বর্তমানে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তৃতীয় স্ত্রী শাহনাজ পারভীনকে নিয়ে সিরাজউদ্দিন কিশোরগঞ্জ শহরের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শাহনাজ পারভীন ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সিরাজের বিরুদ্ধে অনেক প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। কিশোরগঞ্জের আদালতে ৮ লাখ টাকার একটি চেক ডিজঅনারের মামলা চলছে তার বিরুদ্ধে।

যেভাবে বাসা ভাড়া নেওয়া : ২০১২ সালের প্রথম দিকে বাসা ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে পরিচয় হয় আখড়াবাজার পিটিআই দক্ষিণ গলির মৃত আতাউর রহমানের ছেলে সোহেল নামে আরেক যুবকের সঙ্গে। সোহেল ঈশা খাঁ রোডের একজন অটোরিকশা বিক্রেতা। সোহেলের সহযোগিতায় সোনালী ব্যাংক ভবনটির পেছন দিকের এই ছোট বাসাটি আড়াই হাজার টাকায় ভাড়া নেন সিরাজ ও হাবিব। ওই বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় হাবিব জানান, তার নাম সোহেল। বাসার মালিক ফৌজিয়া আক্তার মিনা থাকেন ঢাকায়। বাসা ভাড়া নেওয়ার পর বেশিরভাগ সময়ই হাবিব ওরফে সোহেল থাকত বাসার বাইরে।

আলোচিত প্রেমিকাদের গল্প : হাবিব ওরফে সোহেলের কথিত দুই প্রেমিকাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে রহস্য। হাবিরের প্রথম প্রেমিকা ইয়াসমিন সুলতানা ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ’ নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের ক্ষুদ্রঋণ কর্মী বলে জানা যায়। তবে ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ’-এর কিশোরগঞ্জ এরিয়া ম্যানেজার মো আশরাফুজ্জামান জানান, ইয়াসমিন সুলতানা নামে তাদের কোনো কর্মী এ শাখায় কোনো দিন দায়িত্ব পালন করেননি। জানা যায়, আরেক প্রেমিকা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী সাবিনা ইয়াসমিনকেও মোবাইল ফোনের ফাঁদে ফেলে প্রেমের জালে আটকে ফেলেন সোহেল।

দুঃসাহসিক খোঁড়াখুঁড়ি : গ্রেপ্তারের পর হাবিব জানান, বাসা ভাড়া নেওয়ার ছয় মাস পর থেকে শুরু হয় সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ। প্রতিদিনই একটু একটু করে ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে গর্ত খোঁড়েন হাবিব। ব্যবসায়িক এলাকা আর প্রতিনিয়ত গাড়ি চলাচল করায় অনেক শব্দ হতো। এই সুবিধা নিয়েই হাবিব সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ করতেন দিনের বেলায়। সন্ধ্যায় বাসার সবকিছু বন্ধ করে নগুয়া এলাকায় তার স্ত্রীর কাছে চলে যেতেন। ছয় মাস পর থেকে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে কাটার ও ড্রিল মেশিন ব্যবহার শুরু হয়। কাঠ ও বাঁশ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে কৌশলে বিদ্যুতের বাতি জ্বালিয়ে চলে কাজ। ভুল জায়গার কারণে প্রথমবার তার সুড়ঙ্গ তৈরি ভেস্তে যায়। প্রথমবার তৈরি সুড়ঙ্গ ভল্টের পাশের একটি প্যাসেজ দিয়ে বের হয়। তবে সে দ্রুত তা ভরাট করে ফেলে। এরপর সে ব্যাংকের পিয়ন আবু বাক্কারের সঙ্গে বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি পরিচয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বছর খানেক আগে ভল্টের ভেতর বৈদ্যুতিক সমস্যা দেখা দিলে আবু বাক্কার তা সমাধানের জন্য সোহেলকে নিয়ে আসেন। এভাবে আবু বাক্কারের কাছ থেকে কৌশলে জেনে নেন ব্যাংকের কোন স্থানে কী আছে। জেনে নেন, কখন কখন ভল্ট ও ব্যাংক খোলা হয়। ভল্টের ভেতর বিদ্যুতের কাজ করার সময় সোহেল ভালোমতো ধারণা নেন এবং পরে আবার নতুন করে সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ শুরু করেন। দ্বিতীয় দফায় তিনি সফল হন।

চূড়ান্ত অভিযান : ২৪ জানুয়ারি শুক্রবার রাতে হয় তার চূড়ান্ত অভিযান। ওই দিন রাত ৮টার দিকে সুড়ঙ্গপথে তিনি সোনালী ব্যাংকের ভল্ট কক্ষের মেঝের সন্ধান পায়। এরপর নিজ কক্ষে ফিরে এসে ৪০ টন ও ২০ টনের দুটি জগ ব্যবহার করে ফ্লোর ভাঙার জন্য। এ সময় সে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে একের পর এক ভল্ট ভাঙার কাজ শুরু করেন। রাত ১০টার দিকে পাঁচটি বস্তা নিয়ে আবারও সুড়ঙ্গ দিয়ে ব্যাংকে ঢোকেন হাবিব। টানা চার ঘণ্টায় পাঁচটি বস্তায় টাকা ভর্তি করে রাত ২টার দিকে শেষ হয় তার অভিযান। পরে পাঁচটি টাকাভর্তি বস্তা নিয়ে নিজের কক্ষে ফিরে আসেন তিনি।

এদিকে পুলিশের সূত্র জানায়, হাবিব চুরির ঘটনার পর থেকে ১৯টি সিমকার্ড ও ৯টি মোবাইল ফোনসেট পরিবর্তন করেছিলেন। ওই সব নম্বর মোবাইলের কললিস্টের সূত্র ধরে তার গতিবিধি শনাক্ত করা হয়। বর্তমান র‌্যাবের উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার কারণেই খুব অল্প সময়ে তাকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।

শেয়ার করুন