বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না ছিল অবাধ, না ছিল সুষ্ঠু। সে কারণে তা সঠিক বা যথার্থ হয়নি বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঘোষণা করা উচিত। গত বুধবার রাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফা বিতর্কে এই অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এটি ছিল দ্বিতীয় বিতর্ক। ওয়েস্টমিনস্টার হলে আয়োজিত এই বিতর্কের উদ্যোক্তা বিরোধী দল লেবার পার্টির এমপি গ্যাভিন শুকার, যিনি ছায়া মন্ত্রিসভায় বৈদেশিক উন্নয়ন-সহায়তা দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছায়া প্রতিমন্ত্রী। বিতর্কের শুরুতে গ্যাভিন শুকার ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভের পর থেকে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে বলেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দলের মধ্যকার পারস্পরিক অবিশ্বাস একটি অকার্যকর রাজনৈতিক পরিবেশের চিত্র তুলে ধরে, যেখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান হয়।
ফিলিপ হোলোবনের সভাপতিত্বে আধা ঘণ্টার এই বিতর্কে আরও অংশ নেন লেবার পার্টির এন্ড্রু স্মিথ, জিম কানিংহাম এবং কনজারভেটিভ পার্টির রেহমান চিশতি। আলোচনার সমাপ্তি টানেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিউ রবার্টসন।
এন্ড্রু স্মিথ বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের অন্যতম মৌলিক একটি সমস্যা হচ্ছে, অতীতের নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে যে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা কার্যকর ছিল, সেটি অনুসরণে আওয়ামী লীগের অস্বীকৃতি। জিম কানিংহাম বলেন, নির্বাচন তদারকির জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অনুপস্থিতি দেশটির জন্য একটি বড় বিপর্যয়। বিরোধীদের হয়রানি এবং বিদ্রূপ করা বন্ধের জন্য জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা প্রয়োজন বলেও কানিংহাম মন্তব্য করেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন না ঘটা এবং নতুন বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান বিষয়ে অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র, ফরাসি ও জার্মান সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং ঢাকায় জাপানি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য উদ্ধৃত করে গ্যাভিন শুকার বলেন, ব্রিটেনের এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। তিনি নতুন সরকারের প্রতি রাশিয়া, ভারত, চীন, ভিয়েতনাম ও নেপাল সরকারের সমর্থনের কথা উল্লেখ করে বলেন, সব দেশের ভূমিকা অবশ্য এ ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। উভয় তরফে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করে তিনি সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানান।
দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি সময়সীমার প্রতিশ্রুতি আদায় করা প্রয়োজন কি না, রেহমান চিশতির এমন প্রশ্নের জবাবে গ্যাভিন শুকার বলেন, ‘সময়সীমা ওপর থেকে আমরা চাপিয়ে দিতে পারি না। আগ্রহী দলগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে এটা ঠিক করতে হবে।’
শুকার আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, এর মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হলে সেখান থেকে অন্যান্য নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। তবে রেহমান চিশতি এ ক্ষেত্রেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে বিরোধী দল হয়তো এই নির্বাচনে অংশ নেবে না। শুকার বলেন, বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ঘোষণা করায় তিনি উৎসাহবোধ করছেন।
গ্যাভিন শুকার বাংলাদেশে চলতি বছরে ৭৫০ কোটি পাউন্ড উন্নয়ন-সহায়তা বরাদ্দ থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, এর এক-তৃতীয়াংশ সরাসরি সরকারের কাছে যাবে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যাবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং নিরাপত্তা ও বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে শুরু হওয়া ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের তিনটি লক্ষ্য ছিল—নাগরিক স্বার্থের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সাড়া প্রদান, নির্বাচন কমিশন ও সংসদকে শক্তিশালীকরণ এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অধিকতর জবাবদিহিমূলক করার লক্ষ্যে সুশীল সমাজকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে উদ্বুদ্ধ করা। ২০১৪-এর নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, তিনটি লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রেই অবস্থা আরও দুর্বল হয়েছে। তিনি ব্রিটিশ সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ না করে জরুরি ভিত্তিতে তা পর্যালোচনা করা এবং পর্যালোচনার ফলাফল প্রকাশের আহ্বান জানান।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিউ রবার্টসন বলেন, ‘ব্রিটেনের প্রতিক্রিয়াকে তিনটি ভাগে দেখা যায়। প্রথমত, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অভাব এবং সহিংসতার জন্য আমরা প্রকাশ্যেই হতাশা প্রকাশ করেছি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে সংলাপ শুরুর জন্য আমরা দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। তৃতীয়ত, একটি যথাযথভাবে সচল গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে প্রধান অধিবেশন কক্ষ ছাড়াও ওয়েস্টমিনস্টার হল নামে আরেকটি অধিবেশন কক্ষ রয়েছে, যেখানে সপ্তাহে দুই দিন (মঙ্গল ও বুধ) মুলতবি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মূলত পেছনের সারির এমপিদের উদ্যোগ ও সিদ্ধান্তেই এসব বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।