সাঈদীর আপিল শুনানি অব্যাহত : ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার ঘটনা নিয়ে এজাহার ও সাক্ষীর সাক্ষ্যে বৈপরীত্য

0
118
Print Friendly, PDF & Email

মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে গতকাল সাত নম্বর অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি পেশ শেষে আট নম্বর অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেছেন তার আইনজীবী।
আইনজীবী এসএম শাহজাহান আট নম্বর অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপনকালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানিক পসারির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার ঘটনার সময় নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর একরকম জবানবন্দি এবং মামলার এজাহারে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে বৈপরীত্য তুলে ধরেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিচারপতির আপিল বেঞ্চে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা), আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যে দুটি অভিযোগে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে, তার একটি হলো মানিক পসারির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ লুটপাট, তার কাজের লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা এবং মফিজ পসারিকে নির্যাতন করা। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে মোট নয় জন যথা ২, ৪, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১ এবং ১২ নং সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এ চার্জের ওপর এসএম শাহজাহান আদালতে বলেন, ১৯৭১ সালের ৮ মে চার্জে উল্লেখ আছে মানিক পসারির বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে তিনটায়। কিন্তু ২ নং সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন বলেছেন, তিনি ১১-১২টার দিকে জানতে পেরেছেন আগুন দেয়ার ঘটনা। আসলে তিনি আগুন দেয়ার সময় ঘটনাস্থলে বা তার আশপাশেও ছিলেন না। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের নবম সাক্ষী বলেছেন, ৭ মে’র অনেক আগেই রুহুল আমিন নবীন এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এরপর দেশ স্বাধীনের পর ১৮ ডিসেম্বর পাড়েরহাটে তিনি তাকে প্রথম দেখেন। এসএম শাহজাহান বলেন, রুহুল আমিন নবীন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং নবম সাক্ষী তাকে আগে থেকেই চিনতেন। যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন ২৫ মার্চের পর তাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়াই স্বাভাবিক এবং রাষ্ট্রপক্ষের নবম সাক্ষী সে দাবিই করেছেন। কাজেই রুহুল আমিন নবীন আসলে ৭ মে’র ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন না। এরপর এ অভিযোগ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের চার নং সাক্ষীর সাক্ষ্য বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করে তিনি বলেন, এ সাক্ষীর পরিচয় কি? জেরায় তিনি স্বীকার করেছেন কলা চুরির মামলায় জজ কোর্টে তার সাজা হয়েছে এবং এ মামলা বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া ট্রলার চুরির ২টি মামলা বরিশাল কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।
এর আগে ৭ নং অভিযোগ যথা সেলিম খানের বাড়িতে আগুন দেয়ার বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন আইনজীবী এসএম শাহজাহান। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ৮ নং সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদারের একটি মামলায় সাজা হয় এবং পরে খালাস পান। সেলিম খানের বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা তিনি খালের ওপর থেকে দেখার কথা ট্রাইব্যুনালে বললেও তদন্ত কর্মকর্তাকে তিনি তা বলেননি। তাছাড়া তিনি আরো বলেছেন সাঈদী সেলিম খানের বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় বলেছেন একথাও তাকে মোস্তফা হাওলাদার বলেননি। তাছাড়া ১৫-১৬ বছর আগে সাঈদী নাম ধারণের কথাও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দিতে বলেননি বলে জেরায় স্বীকার করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নং সাক্ষী একেএম আউয়াল জবানবন্দিতে বলেছেন, শুনেছি দানেশ মোল্লা সেকেন্দার শিকদারের সাথে সাঈদী সাহেবও ছিলেন। জেরায় তাকে প্রশ্ন করা হয় সাঈদী সাহেব থাকার যে কথা আপনি শুনেছেন তা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দিতে বলেননি। তিনি জানান, বলেছি। অপরদিকে তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় জানিয়েছেন, শুনেছি সাঈদী সাহেবও ছিলেন—একথা এমপি আউয়াল তার কাছে বলেননি।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণের পক্ষে ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষের তিনজন সাক্ষীর ওপরও নির্ভর করেছে। কিন্তু এর মধ্যে ৩ নং সাক্ষী সাত নং অভিযোগ বিষয়ে কিছুই বলেননি। ট্রাইব্যুনাল রায়ে ভুলক্রমে এটি করে থাকতে পারে। অপরদিকে আসামিপক্ষের ১৫ নম্বর সাক্ষী ৭ নম্বর অভিযোগ বিষয়ে বলেছেন ঘটনার সময় সেলিম খান এবং তার বাবা নুরুল ইসলাম খান কেউ বাড়িতে ছিলেন না। ৭ মে’র আগেই সেলিম খান মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। কাজেই নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয়। অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান বলেন, তাছাড়া ৭ নম্বর চার্জে আগুন দেয়া এবং নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষের কোনো সাক্ষী নির্যাতন বিষয়ে কিছু বলেননি।
তিনি বলেন, এ ঘটনার বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সেলিম খানকে ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি সেফ হাউজে এনে রাখে। ১১ এবং ১২ জানুয়ারি তাকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে আনে কিন্তু সে রাজি না হওয়ায় ১২ জানুয়ারি তাকে গাড়িতে করে আজিমপুরে তার মেয়ের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়।
দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পড়ে শোনানোর সময় আদালত জানতে চান এর ভিত্তি কি। এসএম শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সেফ হাউজ ডায়েরিতে এ তথ্য রয়েছে। আদালত বলে, প্রতিবেদককে আপনারা সাক্ষী করেছিলেন? জবাবে আইনজীবী বলেন, সাক্ষীর তালিকা জমা দেয়ার পরে এ ঘটনা ঘটেছে। আমরা ট্রাইব্যুনালে বার বার বলেছি প্রতিবেদককে সাক্ষী হিসেবে সমন দেয়া হোক। ট্রাইব্যুনাল আমাদের আবেদন খারিজ করেছেন। শুনানি আগামী রোববার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
যুক্তি উপস্থাপনকালে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ট্রাইব্যুনালের প্রধান সমন্বয়ক এম কে রহমান। আসামিপক্ষে গিয়াসউদ্দিন আহমেদ মিঠু, সাইফুর রহমান, তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, তারিকুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রথম ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২৮ মার্চ সাঈদী ও সরকারপক্ষ পৃথক দুটি আপিল (আপিল নম্বর ৩৯ ও ৪০) দাখিল করেন। গত বছরের ৩ এপ্রিল আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল আবেদনের সার-সংক্ষেপ জমা দেন সরকারপক্ষ। ১৬ এপ্রিল সার-সংক্ষেপ জমা দেন আসামিপক্ষ। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণের আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় দুটি অপরাধে সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠন করা অভিযোগে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয়জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাংচুর এবং ১শ’ থেকে ১৫০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো ২০টি ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ৮টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে অর্থাত্ ৮ ও ১০ নং অপরাধে মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এছাড়া ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯ নং অভিযোগ প্রমাণিত হলেও এগুলোতে কোনো সাজার কথা ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল জানান, দুই অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় বাকিগুলোতে আর সাজা দেয়ার প্রয়োজন নেই। আর বাকি ১২টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ না হওয়ায় সেগুলোতেও কোনো সাজা ঘোষণা করা হয়নি। সাজা ঘোষিত না হওয়া ওই ৬টি অভিযোগে শাস্তির আরজি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আর মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আসামিপক্ষ আপিল করেন।

শেয়ার করুন