লুটের আগে কিশোরগঞ্জের সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার ভেতরে শতাধিকবার গিয়েছিল সোহেল। তার উদ্দেশ্য ছিল রেকি করা। বিভিন্ন অজুহাতে ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে ভল্টরুমের অবস্থান চিহ্নিত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। তাকে এ কাজে সহায়তা করেছে ব্যাংকের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আবু বকর। ভল্টরুমের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি সে সুড়ঙ্গও খুঁড়ে যেতে থাকে। তবুও ভুলপথে গিয়েছিল সুড়ঙ্গ। পরে আবারও ব্যাংকের ভেতরে ও বাইরে বারবার রেকি এবং গোপনে মাপজোখ করে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পৌঁছে যায় কাঙ্ক্ষিত স্থানে। মঙ্গলবার বিকালে দুঃসাহসিক এ চুরির মূল হোতা হাবিব ওরফে সোহেল ও ঢাকায় তার আশ্রয়দাতা ইদ্রিসকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। উদ্ধার করা হয় লুট করা ১৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। মঙ্গলবার রাতভর র্যাব সদর দপ্তরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় সে দুঃসাহসিক চুরির বিস্তারিত বর্ণনা করে। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, হাবিব ওরফে সোহেল একাই সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে বলে দাবি করলেও এটি অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। তার মামাশ্বশুর সিরাজ ছাড়াও সঙ্গে আরও কেউ জড়িত থাকতে পারে। সোহেলকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও চাঞ্চল্যকর কাহিনী পাওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে সোহেলের দাবি মতো তার মামাশ্বশুরকে ধরতে পারলে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। তাকে ধরার জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
এদিকে গতকাল সকালে গ্রেপ্তারকৃত সোহেল ও তার সহযোগী ইদ্রিসকে কিশোরগঞ্জের সদর থানায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল মালেকের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। সিজার লিস্ট করে টাকাগুলোও আদালতের নির্দেশে তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জিম্মায় দেয়া হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ সদর থানার ওসি আবদুল মালেক জানান, বৃহস্পতিবার হাবিব ওরফে সোহেল ও তার সহযোগীকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করা হবে। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে বলে তিনিও আশা প্রকাশ করেন।
হাবিব ওরফে সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদকারী র্যাব কর্মকর্তারা জানান, কিশোরগঞ্জের সোনালী ব্যাংকের ওই শাখায় সোহেলের একটি ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। হাবিব নামে একাউন্টটি করা হয়েছিল। এ ছাড়া তার মামাশ্বশুর সিরাজের একটি ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। ব্যাংকলুটের পরিকল্পনার পর গত দুই বছরে শতাধিকবার সে ওই ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশ করে। কারণে-অকারণে ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশ করে সে ভল্টরুমের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতো। সে মনে মনে ভল্টরুম দেখার চেষ্টা করলেও কখনও ভল্টরুম পর্যন্ত যেতে পারেনি। তবে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এমএলএসএস আবু বকরের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে তার কাছ থেকেই ভল্টরুমের সব তথ্য সংগ্রহ করে। এমএলএসএস আবু বকর তাকে জানায়, ভল্টরুমের ভেতরে কিভাবে আলমারিতে টাকা রাখা হয়। এ ছাড়া আলমারির লক সিস্টেম সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করে সোহেল। সোহেল জানায়, সুড়ঙ্গ খোঁড়ার মাঝামাঝি পর্যায়ে গিয়ে কয়েক মাস আগে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ হিসেবে সে বলে, এ সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শুক্র-শনিবারও ব্যাংক খোলা থাকতো। এ কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সে অপেক্ষা করে। ব্যাংক শুক্র-শনিবার বন্ধ রাখা পুনরায় চালু হলে সে আবারও সুড়ঙ্গ খননকাজ শুরু করে।
ভল্টের আলমারি ভাঙার প্রস্তুতিও ছিল তার: গ্রেপ্তারকৃত সোহেল জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ব্যাংকের ভল্টের ভেতরে স্টিলের আলমারির তালা ভাঙতে সব ধরনের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিল। এ জন্য মামাশ্বশুর সিরাজ তাকে কাটার মেশিন ও ড্রিল মেশিন কিনে দিয়েছিল। কাটার সময় সে বৈদ্যুতিক তার টেনে সুড়ঙ্গে আলো জ্বালানোর পাশাপাশি ইলেকট্রিক কাটার মেশিন ব্যবহার করতে চেয়েছিল। ভল্টরুমে ঢুকে পুরো টাকা হাতের নাগালে পেয়ে যাওয়ায় তাকে আর কোন কিছুই করতে হয়নি। ভাঙতে হয়নি আলমারিও। টেবিলের ওপর বিছানো টাকাই সে বস্তায় তুলে নেয়। তবে লোভ সংবরণ করতে না পেরে আলমারি ভাঙার একবার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু এতে আরও বেশি সময় লাগবে বলে আলমারির তালা আর ভাঙেনি। সোহেল জানায়, শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় সে ভল্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর তার ব্যবহৃত সব যন্ত্রপাতি নিয়ে বের হয়ে যায়। এগুলো শহরের তেরপট্টি এলাকার রাস্তার পাশে ফেলে দেয়।
এত টাকা আলমারির বাইরে কেন: দুঃসাহসিক ব্যাংকলুটের পর ব্যাংকের ভল্টের ভেতরে এত টাকা আলমারির বাইরে কেন রাখা হয়েছিল- এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারাও এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদেরও ধারণা, ভল্টের আলমারির বাইরে এত টাকা একসঙ্গে রাখার সঙ্গে চোরচক্রের কারও সদস্যের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কারও সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। কিন্তু সোহেলকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এমএলএসএস আবু বকর ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না বলে জানিয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সোহেলের মামাশ্বশুর সিরাজের কারও যোগসাজশ থাকতে পারে বলে র্যাব-পুলিশ কর্মকর্তারা সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তবে মঙ্গলবার র্যাব সদর দপ্তরে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, লুট হওয়ার সময় ওই ব্যাংকে অন্তত ২০০ কোটি টাকা ছিল। তার পরও আলমারির বাইরে টেবিলে কেন এত টাকা রাখা হয়েছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মামাশ্বশুর সিরাজকে ধরতে অভিযান: সোহেলের দাবি মতে, তার মামাশ্বশুর সিরাজই তাকে ব্যাংকলুটে প্ররোচনা ও দিকনির্দেশনা দেয়। প্রথম দিকে ওই সিরাজ তার সঙ্গে খননকাজেও সহযোগিতা করে। কংক্রিট ভাঙতে তার মামাশ্বশুর তাকে সহযোগিতা করেছে। এ ছাড়া কবে, কখন লুট করা হবে সে দিকনির্দেশনাও সিরাজ দিয়েছিল। এ কারণে সোহেলের দেয়া তথ্য মতে, র্যাব-পুলিশ সিরাজকে ধরতেও অভিযান শুরু করেছে। কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা সিরাজ একসময় গাজীপুরের আনোয়ার ইস্পাতের একটি নির্মানাধীন ভবনের অস্থায়ী ফোরম্যান হিসেবে কাজ করতো। থাকতো গাজীপুরে। কিন্তু ব্যাংকলুটের জন্য সুড়ঙ্গ খোঁড়ার পুরো দুই বছর সে কিশোরগঞ্জেই অবস্থান করে। লুটের পর রোববার পর্যন্ত তার মোবাইল ফোনও খোলা ছিল। কিন্তু ব্যাংকলুটের খবরটি চাউর হয়ে গেলে সে আত্মগোপনে চলে যায়। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, সিরাজকে ধরতে পারলে আরও বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে।
লুটের টাকা দিয়ে বাড়ি করতে চেয়েছিল সোহেল: ব্যাংক থেকে লুট করা টাকা দিয়ে ঢাকায় একটি বাড়ি কিনতে চেয়েছিল সোহেল। সোহেল জানায়, ঠিকঠাকভাবে ঢাকায় টাকা পৌঁছানো গেলেও তার মনে সব সময় ভয় কাজ করেছে। শ্যামপুরের ওই বাসায় রোববার সে খাটসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র কিনে আনে। আড়াই কক্ষের বাসাটিতে বেডরুমের খাটের নিচে রাখে টাকার বস্তাগুলো। কিন্তু তার মনে কোন শান্তি ছিল না। সব সময় ধরা পড়ার ভয় আচ্ছন্ন করেছিল তাকে। এমনকি কোটি কোটি টাকা বিছানার নিচে রেখে রাতে তার ঘুমও হয়নি। তার পরিকল্পনা ছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে সে ঢাকায় একটি সুবিধামতো স্থানে বাড়ি কিনবে। ওই বাড়ি ভাড়া দিয়েই তার বাকি জীবন চলে যেতো। কিন্তু ধরা পড়ার পর তার সব স্বপ্ন ভেস্তে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের পুরোটা সময় স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেয় হাবিব ওরফে সোহেল।
সহজেই জামিন পেতে পারে সোহেল: দুঃসাহসিক ও দুর্ধর্ষভাবে সুড়ঙ্গ কেটে ব্যাংক থেকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা চুরি করলেও সহজেই জামিন পেয়ে যেতে পারে এর মূল হোতা হাবিব ওরফে সোহেল। এ ঘটনায় কিশোরগঞ্জ সদর থানায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ডিজিএম বাদী হয়ে একটি চুরির মামলা (ধারা ৪৬১, ৩৮০) হয়। চুরিকৃত মালামাল উদ্ধার হওয়ায় এর সঙ্গে পেনাল কোডের ৪১১ ধারা (মালামাল উদ্ধার) যুক্ত করা হয়েছে। এ মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। তবে চুরির মামলায় সাধারণত আসামিরা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। এ মামলাতেও আসামিরা সহজেই জামিন পেতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।