ঢাবিতে কৌশলে কোটি টাকার বাণিজ্য

0
106
Print Friendly, PDF & Email

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে দুইটি কনস্ট্রাকশন ফার্ম।

তমা ও মল্লিক নামের কনস্ট্রাকশন ফার্ম দুইটি অভিনব কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। আর এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন নির্মাণকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন তারা।

প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবনের কাজের নামে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ থেকে নিজেদের প্রজেক্টের রসদ সরবরাহ করছেন তারা।

শিক্ষার্থীদের অনুরোধ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশ এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশনাও মানছেন না তারা।

বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য একাধিকবার মৌখিক ও লিখিত নির্দেশ দিলেও তা উপেক্ষা করে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এক্ষেত্রে প্রশাসনের যোগসূত্রতা রয়েছে বলে ধারণা করছেন অনেকে।

জানা যায়, ২০১১ সালের মার্চ মাসে তমা ও মল্লিক নামের দুইটি নির্মাণ কোম্পানি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন নির্মাণের কাজ হাতে নেয়। প্রথম দিকে মল্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র টিচার্স কোয়ার্টার, গণিত ভবন নির্মাণ প্রকল্প দিয়ে শুরু করে তাদের কার্যক্রম। এরপর বঙ্গবন্ধু ভবনের কাজ হাতে নেন তারা। এর এক মাস পরে তাদের সঙ্গে যোগ হয় তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।

কোম্পানি দুইটি তাদের রসদ রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠকে বেছে নেয়। পরে সেখানে অবস্থান করে খেলার মাঠের একাংশ টিনশেট দিয়ে ঘিরে ফেলেন তারা। শুরু করেন তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম। দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের ব্যবসা। শহরের বিভিন্ন স্থানে সাপ্লাই দিচ্ছেন তাদের নির্মাণ সামগ্রী। আয় করছেন কোটি কোটি টাকা। তবে কোনো মাথাব্যথা নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

দীর্ঘদিন ধরে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে নির্মাণ সামগ্রীর রসদ প্রস্তুত করে যাচ্ছেন। পরে এগুলো মিরপুর, কল্যাণপুর, মগবাজার ও যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তাদের নিজস্ব প্রজেক্টে সরবরাহ করেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী জনাব মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, তমা ও মল্লিক কনস্ট্রকশন ফার্ম শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বাইরের কোনো কার্যক্রম চালালে আমরা সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।

এ বিষয়ে অবগত হওয়ার পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে অবৈধ দখল বন্ধে একটি রিট আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কোর্ট সেদিন মাঠের নির্মাণ সামগ্রী সরানোর আদেশ দিয়ে রুল জারি ও মাঠে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার অধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।

এ ছাড়া গত বছরের ২৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তমা ও মল্লিক কস্ট্রাকশন কোম্পানির কাছ থেকে মাঠ দখলমুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে জায়গা না ছাড়লে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। সিন্ডিকেটের এ সিদ্ধান্ত চিঠির মাধ্যমে জানানোর কথা থকালেও অজ্ঞাত কারণে সে চিঠি এখনও ইস্যু করা হয়নি বলে জানা গেছে। এর পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরমহলের যোগসূত্রতা আছে বলে মনে করছেন অনেকে।

তমা কনস্ট্রাকশনের অফিস ইনচার্জ মনিরুজ্জামান বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে হাইকোর্টের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে তাদেরকে কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শেষে তাদেরকে মাঠ ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিনিয়র টিচার্স কোয়ার্টার, গণিত ভবন নির্মাণ প্রকল্প দিয়ে শুরু হয় মল্লিক কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বুলডোজারসহ নানা যন্ত্র ও সামগ্রী নিয়ে অবস্থান নেয় মল্লিক কনস্ট্রকশন।

এর কিছুদিন পর জায়গা দখল করে তমা কনস্ট্রাকশন। যদিও তাদের জন্য সুফিয়া কামাল হলের পাশে আলাদা একটি জায়গা রয়েছে। কার্জন হলের পাশে ছাত্রীদের জন্য নির্মাণাধীন কবি সুফিয়া কামাল হলের টেন্ডারের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি তমা। এরপর তারা কাজ নেয় ছাত্রদের জন্য নির্মাণাধীন বিজয় ৭১ হল, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য প্রস্তাবিত ২০তলাবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু ভবন এবং সর্বশেষ যুক্ত হয় মেয়েদের জন্য বর্তমানে নির্মানাধীন ৭ মার্চ ভবন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্মাণাধীন ভবনগুলোর মধ্যে শুধু ছেলেদের জন্য নির্মাণাধীন ভবন বিজয় ৭১ হলের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণ শুরুর প্রায় তিন বছর অতিবাহিত হলেও বঙ্গবন্ধু ভবনের কার্যক্রম এখনও অর্ধেক বাকি রয়ে গেছে, টিচার্স কোয়ার্টারের কাজ এক তৃতীয়াংশ সম্পন্ন হয়েছে। কাজ শুরুর দুই বছর অতিবাহিত হলেও গণিত ভবনের কাজ অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছে। কাজ শুরুর এক বছর অতিবাহিত হলেও ৭ মার্চ ভবনের কাজ ১০-১৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে প্রশাসনের দুর্বলতা আছে বলে দাবি করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক শিক্ষার্থী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মল্লিক কনস্ট্রাকশনের কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা অবৈধ কোনো কাজ করি না এবং এজন্য কোনো চিঠিও দেওয়া হয়নি। অনুমতি নিয়ে কাজ করছি।

জানা যায়, ইতোমধ্যে কোম্পানি দুইটি কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জায়গা দখলে নিয়েছে। যার কারণে সংকোচিত হয়ে পড়েছে মাঠের পরিধি। আর দখলকৃত জায়গা থেকে বালু-পাথর মিশ্রিত পানি আসায় খেলার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে মাঠ।

এ ছাড়া মাঠ দখল করে শুরু হয় রাজধানীব্যাপী তাদের ব্যবসা। রাতের অন্ধকারে তমা কনস্ট্রাকশন মিরপুর ও যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন স্থানে সিমেন্ট-বালুর মিশ্রণসহ কাঁচামাল নিয়ে যায় বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।

অপরদিকে মল্লিকও এখান থেকে রাজধানীর দুইটি প্রকল্পে রসদ সরবরাহ করে থাকে। এ ছাড়া কোম্পানি দুইটি অবৈধভাবে ব্যবহার করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বিদ্যুৎসম্পদ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রিড়াপ্রেমী শিক্ষার্থী জানান, মাঠের একটি বিশাল অংশ দখল করে রাখায় মাঠ ছোট হয়ে গেছে এবং যে অংশ আছে তা খেলার অনুপযোগী হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু নেয়নি। এক্ষেত্রে ওপরমহলের কারও হাত থাকতে পারে বলে তিনি দাবি করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, আমরা তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের বাইরে কোনো বাড়তি কাজের অনুমতি দেইনি। কয়েকবার তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর আসেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এ বিষয়ে সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অবশ্যই তাদের উচ্ছেদ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কোনো কাজ করলে সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। অবৈধ কার্যক্রম করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে চিঠি না পৌঁছানোর বিষয়টি আমি জানি না। খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।

শেয়ার করুন