দেশে কোটিপতির সংখ্যা ৪৬ হাজার

0
100
Print Friendly, PDF & Email

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে দেশে কোটিপতির সংখ্যা রেকর্ড ভেঙেছে। দেশে বর্তমানে কোটিপতির সংখ্যা ৪৬ হাজার ১৩৫ জন। আর ৫০ কোটি টাকার ওপরে মালিকের সংখ্যা ৪১৬ জন।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে (জানুয়ারি ২০০৯-জুন ২০১৩) পর্যন্ত দেশে প্রায় ২৭ হাজার নতুন কোটিপতির উত্থান ঘটেছে। স্বাধীনতার পর থেকে অষ্টম সংসদের নির্বাচিত সরকার গঠন পর্যন্ত অথ্যাৎ ৩৭ বছরে যে পরিমাণ কোটিপতি বেড়েছে; গত মহাজোট সরকারের আমলে তার দ্বিগুণের চেয়েও বেশি কোটিপতি হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণের বেশি কোটিপটি বাড়ায় ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা বাড়ছে, এটি ইতিবাচক, কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ছে, তবে পাঁচ বছরের দেশে আর্থসামাজিক অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি যে, নতুন কোটিপতির সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়বে। তাদের মতে, ‘বাংলাদেশে বৈধ পথে কোটিপতি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। দুর্নীতি, লুটতরাজই আমাদের দেশে কোটিপতি হওয়ার প্রধান পদ্ধতি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে অষ্টম সংসদের নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যখন (জানুয়ারি ২০০৯) ক্ষমতায় আসে; তখন দেশে মোট কোটিপতির সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৬৩ জন। ২০১৩ সালের জুন শেষে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ১৩৫ জনে। অর্থাৎ মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ২৬ হাজার ৯৭২ জন। এ বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

আলোচ্য সময়ে ৫০ কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা বেড়েছে ৩১০ জন, যা পাঁচ বছর আগে ছিল ১০৬ জন। আর সব শেষ হিসেবে দাঁড়িয়েছে ৪১৬ জন। সে হিসেবে সাড়ে চার বছরে অর্ধশত কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা বেড়েছে ৭৪ দশমিক ৫২ শতাংশ।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। বঙ্গবন্ধূ শেখ মুজিবুর রহমান (ডিসেম্বর ১৯৭৫) ও জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে (ডিসেম্বর ১৯৮০) এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৭ ও ৯৮ জনে। তখন তাদের আমানতের পরিমাণ ছিল ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ১০ শতাংশ। এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩ জন ও আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ শতাংশ। এ ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতির মোট সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৯৪ জন ও আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ২০ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোটিপতির মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জন।

মহাজোট ক্ষমতায় আসার আগে দু’বছরের (২০০৭-০৮) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৫ হাজার ১১৪ জন এবং এরও আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (অক্টোবর ২০০১-ডিসেম্বর ২০০৬) কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছিল ৮ হাজার ৮৮৭ জন।

আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ৪৬ হাজার ১৩৫ জন। এটা ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতকারীর মাত্র দশমিক ০৭ শতাংশ। অন্যদিকে তাদের মোট আমানতের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যা ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের প্রায় ৪০ শতাংশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হিসাব সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার ওপরে হিসাব সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ১৩০টি। ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৫৩৭টি। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে শেষে এক কোটি টাকা লেনদেন হিসাবের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার ৬৯৮টি। ২০১২ সালে ব্যাংকগুলোতে এক কোটির ওপরে থাকা হিসাব সংখ্যা ছিল ৪৩ হাজার ৭১২টি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ প্রাইমনিউজ.কম.বিডিকে বলেন, দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা বাড়ছে, এটি ইতিবাচক। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, শিল্পায়ন বেড়েছে। তবে কারা এ সব বিত্তের মালিক হচ্ছেন এবং এর ফলে অসাম্য বাড়ছে কি না-এ সব নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।’

তিনি বলেন, তবে চোখের সামনে কোটিপতিদের একটি বড় অংশ বছরের পর বছর রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সাবেক এ গভর্নর মনে করেন ব্যাংকগুলোতে এসব অর্থ জমা না করে যদি উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করেন; তাহলে কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি অর্থনীতির চাকাকে আরো গতিশীল করবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত এ বিষয়ে বলেন, পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশে আর্থসামাজিক অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। এ অবস্থায় এত বিপুল কোটিপতি বেড়েছে মানেই অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সমাজের একটি অংশ বড় অঙ্কের কালো টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, দেশীয় প্রেক্ষাপটে কালো টাকা সঞ্চিত রাখার একটা বড় নিরাপদ স্থান হচ্ছে এফডিআর বা আমানত হিসেবে ব্যাংকে রাখা। তিনি আরও বলেন, যদি ধরেই নেওয়া হয় দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তবে ব্যক্তি আয়ও বাড়ছে, যদিও এটি বৈষম্যমূলক।

অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘বাংলাদেশে বৈধ পথে কোটিপতি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। লুটতরাজই আমাদের দেশে কোটিপতি হওয়ার প্রধান পদ্ধতি। বাংলাদেশে কোটিপতিদের আদি সঞ্চয়নও হয়েছে অবৈধ পথে, কালো টাকার মাধ্যমে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান প্রাইমনিউজ.কম.বিডিকে বলেন, দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে; যার কারণে কোটিপতির উত্থানের বিষয়টি স্বাভাবিক।আর কোটিপটির হিসাবধারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অর্থই হলো দেশের অর্থনীতি গতিশীল রয়েছে।

তিনি বলেন, এক সময় যারা হাজার টাকার মালিক হতেন, তাদের নামের সাথে হাজারী যোগ করতেন। আর যারা লাখপতি ছিলেন, সেটা জানানোর জন্য তাদের বাড়ির গাছের উচু ডালে বাতি জ্বালিয়ে রাখতেন।তবে এখন কোটিপতিদের এসব ঘটনা ঘটে না।

শেয়ার করুন