হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে হোমিওপ্যাথির মাত্রা যত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হবে, ওষুধের কার্যকারিতা নাকি ততই বাড়তে থাকবে। এই প্রবাদবাক্যটি আমি কোনো হোমিও চিকিৎসক কিংবা রোগীর কাছ থেকে শুনিনি। ছাত্রজীবনে আমি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তো মূল দলটি যখন ধারাবাহিক ভাঙনের মাধ্যমে খ–বিখ-, তখন আমাদের এক প্রাজ্ঞ নেতার কাছ থেকে শুনেছিলাম এই আপ্তবাক্যটি। আমার হতাশা কাটাতে বলেছিলেন তিনি। বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন, দলের মূল আদর্শের সঙ্গে যারা নিজেদের মিলাতে না পারছে, তারা ঝরে পড়ছে। আর যারা আদর্শিকভাবে বলীয়ান, টিকে থাকছে তারাই। ফলে দল আরো সাচ্চা হচ্ছে। শুনতে যেমনই লাগুক, এই যুক্তির কার্যকারিতা যে ততবেশি ইতিবাচক হয়নি, তা গত দুই দশকে অনেকটাই টের পেয়েছি। জাতীয় পার্টিও এখন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে গেছে। আসলে এই প্রক্রিয়া এবং পরিণতি অনেকটাই অবধারিত ছিল। জনসমর্থনের বিবেচনায় দেশের তৃতীয় বৃহত্তম এই দলটির জন্মের দিকে তাকালে অবশ্য তার সম্ভাব্য এই পরিণতি নিয়ে অনেকই অবাক হবেন না। কিছুদিন আগে, গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে, জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে বিতর্ক চরমে উঠেছিল। পার্টির সর্বময় মালিক, বৃদ্ধ এরশাদ তার পারিষদবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে ঘোষণা করলেন যেÑ তার দল আসন্ন নির্বাচনে যাবে। এর সপ্তাহখানেক আগে এই লোকটিই বলেছিলেন, বিএনপিকে বাদ দিয়ে এ দেশে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। এমন একটি নির্বাচনে গেলে জনগণ তাকে থুতু দেবে। মাত্র দশ দিনের মাথায় সেই লোকটিই নিজের কথা থেকে কেবল সরেই এলেন না, রীতিমতো উল্টে দিলেন। বললেন, নির্বাচনে না গেলে নাকি দেশের রাজনীতিবিদদের থুতু দেবে জনগণ। আগে থুতু লাভের ভয় ছিল তার একার, এবার ভয়টা বিস্তৃত হলো সকল রাজনীতিকের ওপর। আর যেহেতু তিনি সবচেয়ে বয়স্ক, তাই নিজে থেকেই দায়িত্ব নিয়ে, সব রাজনীতিবিদের সেই থুতু প্রাপ্তির অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার এই দিকনির্দেশনার পর পার্টির লোকজন সারাদেশে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র দাখিল করল। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিন পর্যন্ত তিনি আর কিছু বললেন না। তিনি নিজেও তিনটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন। শেষদিন পার হওয়ার পরের দিনেই আবার উল্টে গেলেন এরশাদ। বললেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। একই সঙ্গে তিনি, দলের যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিল তাদের প্রত্যাহার করতে বললেন। তার কথা কেউ কেউ মানলেন, অনেকে মানলেন না। এই অবাধ্যদের তালিকার একেবারে প্রথম নামটিই রওশন এরশাদ, তার প্রিয়তমা স্ত্রী। অবস্থাটা তখন এমন দাঁড়ালো, এরশাদ যা বলেন, তার স্ত্রী বলেন তার উল্টোটা। দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী চলছেন রওশন এরশাদের কথা মতো সাবেক সেনাপ্রধান, অবৈধভাবে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসক এরশাদ জীবনে প্রথমবারের মতো পড়লেন এক অসহায় অবস্থায়। জীবনে এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েননি তিনি। বিপদে পড়েছেন, জনগণ তার বিপক্ষে গেছে, ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছে, নিজেরই নিয়োগ দেয়া সেনাপ্রধান তাকে পিঠ দেখিয়েছেÑ এসব বিপদই তার জন্য ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ঘরের স্ত্রী যে এভাবে মুখ ঘুরিয়ে নেবে, তা হয়ত ভাবতে পারেননি তিনি। এরকম পরিস্থিতিতেই সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলেনÑ তাহলে জাতীয় পার্টির করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার এখন কার? ততদিনে রওশন এরশাদের অনুসারীরা বলতে শুরু করেছেন যে, রওশন এরশাদই এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এ বিষয়টা সম্পর্কেও সাংবাদিকরা জানতে চাইলেন এরশাদের কাছে। জবাবে এরশাদ উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, আমিই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। যতদিন জীবিত আছি, আমিই চেয়ারম্যান থাকব। আমি যেভাবে বলবÑ সেভাবেই চলবে জাতীয় পার্টি।
হুঙ্কার ঠিকই ছিল, তবে ততদিনে পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে। তাই স্ত্রীসহ দলের লোকেরাও সেটাকে আর বাঘের হুঙ্কার হিসেবে গুরুত্ব দেয়নি, বিবেচনা করেছিল বিড়ালের ভেঙ্চি হিসেবেই। নিজেকে বাঘ মনে করতেন যে দৌর্দ-প্রতাপ স্বৈরশাসক, তিনি যে কিভাবে কখন মেনিবিড়ালে পরিণত হয়ে গেছেন, তা নিজেও বুঝতে পারেননি। তবে, জনগণ ঠিকই বুঝেছে। রাজনীতি সম্পর্কে যাদের কিছু মাত্র ধারণা আছে, তারা বুঝেছেন- ন্যূনতম রাজনীতির চর্চা নেই যে দলের মধ্যে, তার পরিণতি এমন হওয়াই স্বাভাবিক।
শুরুর দিকে যদি তাকাই, তাহলে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। সেই ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম এই দলটির। জাতীয় পার্টির জন্ম কিন্তু এরশাদের হাত দিয়ে নয়, দলটি গঠিত হওয়ার পর এরশাদ এর সদস্যপদ গ্রহণ করেন, এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাকে দলের চেয়ারম্যানের পদ দেয়া হয়। সে হিসাবে বলা যায়, এরশাদের হাত দিয়ে না হলেও, এরশাদের জন্যই জন্ম হয়েছে দলটির। সেই যে চেয়ারম্যান হলেন, গত ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত আছেন দৌর্দ- প্রতাপের সঙ্গে। মাঝে ১/১১-এর টালমাটাল অবস্থায় চাপে পড়ে কিছুদিনের জন্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ করেছিলেন, বলেছিলেন রাজনীতি থেকে অবসর নিচ্ছেন। কিন্তু এরপর পরিস্থিতি তার অনুকূলে আসার পর কখন যে আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে সরিয়ে আবার চেয়ারম্যানের পদটিতে বসে গেছেন, অনেকে তা টেরও পায়নি। তবে এবার মনে হচ্ছে আসলেই কিছুটা ঝামেলায় আছেন এই সাবেক জেনারেল।
এই ঝামেলার কারণ কিন্তু কেবলই ব্যক্তি রওশন এরশাদ নয়। এর পেছনে রয়েছে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারও। সরকার রওশনকে সমর্থন দিচ্ছে। আর যেহেতু শুরু থেকেই এই দলে যারা সমবেত হয়েছে তাদের লক্ষ্যই ছিল নানা ফাঁক-ফোঁকড়ে কিছু সুবিধা লাভ করা, তাই তারাও সরকারি আনুকূল্য পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রওশন এরশাদের দিকে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এখনো সর্বময় ক্ষমতা দলীয় চেয়ারম্যান এরশাদের হাতে। কিন্তু ক্ষমতা কিংবা আদেশ তো এমনই বায়বীয় বিষয় যে, অমান্য করার মতো শক্তি থাকলে তা পরিণত হয় ফাঁপা হুঙ্কারে। আদেশ দানকারী ব্যক্তিটি তখন পরিণত হয় হাস্যকর মানুষে। এরশাদের হয়েছে এখন সেই অবস্থা। তার কথা কেউ শুনছেন না। কেবল যারা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি, সেই বঞ্চিতরা ঘুর ঘুর করছেন তার আশপাশে।
এরশাদ দলীয় চেয়ারম্যান, কৌশলী পদ্ধতিতে এমপি হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী দয়া করে তাকে একটা মন্ত্রীর সমতুল্য পদ দিয়েছেন, তার পরও দলের রাজনীতিতে তিনি পরিণত হয়েছেন ‘দুধভাত’ ব্যক্তিতে। এই সংসদে জাতীয় পার্টির ভাগে ছয়জন মহিলা এমপি মনোনয়নের সুযোগ রয়েছে। সেই সৌভাগ্যবতীদের নির্বাচনের সুযোগও এরশাদের রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ অনেক মহিলার মধ্য থেকে কয়েকজনকে বেছে পছন্দ করার বিষয়টি এরশাদের সবচেয়ে প্রিয় কাজ। কিন্তু এ কাজটিও তিনি এবার মন দিয়ে করতে পারছেন না। যাদের পছন্দ করে দিচ্ছেন, তার স্ত্রী তাদেরকে ফেলে দিচ্ছেন বাতিলের তালিকায়।
এতদিন জাতীয় পার্টিতে এরশাদের ইচ্ছাই ছিল আদেশ। আর তার আদেশ মানেই অবশ্যপালনীয়। তিনি কখন কাকে দলের প্রেসিডিয়ামের সদস্য বানাবেন, আবার কখন কাকে বাদ দেবেনÑ সবই হতো তার একক সিদ্ধান্তে। এজন্য কারও কাছে জবাবদিহিরও কোনো প্রয়োজন ছিল না। যদি কেউ ভুল করেও প্রশ্ন তুলত, তাহলে বরং তার অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি পড়ে যেত। তার এই স্বৈরাচারী চরিত্র এখনো আছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের মতো শক্তি হয়ত সাময়িক সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে আছে।
আর সে কারণেই এখন একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পার্টির ভবিষ্যৎ কি হবে। রওশন এরশাদ এবং তার অনুসারীরা যদি সরাসরি সরকারের প্রশ্রয়ে না থাকতেন, তাহলে হয়ত এতদিনে অন্য কোনো দৃশ্যের অবতারণা হতো। এই যে কিল খেয়েও হাসিমুখে থাকার কষ্টকর প্রচেষ্টাÑ হয়ত এরশাদ তার এই অপমানজনক অবস্থান সহ্য করতেন না। কিন্তু তার সামনে খাড়া হিসাবে ঝুলছে এখন ১০ ফ্রেব্রুয়ারির মঞ্জুর হত্যা মামলার নিম্ন আদালতের রায়। এর পরও থাকবে এর বেশ কিছু আইনগত ধাপ। তারও পরে রয়েছে সপ্তম সংশোধনীর নিয়ে মামলার ভয়। আর সবকিছুর ওপর, বর্তমান সরকারের শাসনামল দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা। তবে কোনো পরিস্থিতিই চিরস্থায়ী হওয়ার নিয়ম কখনো প্রকৃতিতে নেই। এরশাদের বয়স এখন ৮৬ বছর। বাঙালির আয়ু নিয়েও বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। তবে যা কিছুই ঘটুক না কেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় পার্টিতে যে আরো কয়েকটি ভাঙন আসছে সেটা বলা যায় নির্দ্বিধায়। অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখি, ক্ষমতা থেকে নামার পর এই পার্টি অনেকবার ভেঙেছে। তিন মহাসচিব, ডা. এমএ মতিন, নাজিউর রহমান মঞ্জুর এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জু’র নেতৃত্বে তিনবার ভেঙেছে। বিজেপি, জেপি নামে এগুলোর অপভ্রংশ এখনো রাজনীতির মাঠে টিমটিম করে জ্বলে আছে। সবশেষ এবার কাজী জাফরের নেতৃত্বে ভাঙলো আবার। এছাড়া মওদুদ আহমেদ, শাহ মোয়াজ্জেমের মতো অনেক কেন্দ্রীয় নেতা ডিগবাজি মেরে দলও ত্যাগ করেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব পেতে পারেÑ এমন কোনো নেতাই আর অবশিষ্ট নেই দলটিতে। প্রেসিডিয়ামের সদস্য হিসেবে যারা আছেন, এদের সিংহভাগেরই সামর্থ্য নেই নিজ এলাকায় নিজের যোগ্যতায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার। বর্তমানের মহাক্ষমতাধর যে রওশন এরশাদ, তিনিও ২০০৮ সালের নির্বাচনে একাধিক আসনে মনোনয়ন পেলেও সব ক’টিতেই হেরেছেন। মহাজোটের প্রবল জোয়ারের সময় প্রার্থী হয়েও হেরেছেন।
এসব আগাছা টাইপের নেতারা সব সময়ই ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট পেতে হা করে থাকে। তাই এখন যদি এরশাদ আবার তার চেয়ারম্যান সুলভ ক্ষমতার প্রয়োগ করতে যান, দেখা যাবে আওয়ামী জাতীয় পার্টি কিংবা জাতীয় পার্টি (এমপি/সংসদ সদস্য) নামে নতুন একটা পার্টির জন্ম হচ্ছে। আর যদি, রাজনৈতিক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, মুক্তভাবে রাজনীতির সুযোগ পেয়ে যান এরশাদ, তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়Ñ দল থেকে বহিষ্কৃৃত হবেন আনিস, বাবলু, চুন্নু জাতীয় বেশ কিছু নেতা। তখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারা যে নতুন আর একটা ‘জাতীয় পার্টি’ নামধারী কিছু গঠন করবেন না- তাও বলা যায় না। আর যদি বয়সজনিত কারণে এরশাদের শারীরিক অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়, তখন হয়ত উত্তরাধিকারের আধিক্যে টুকরার সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
তবে এতকিছুর পরও, জাতীয় পার্টির একনিষ্ঠ ভক্তদের (যদি আদৌ তেমন কেউ থেকে থাকেন) হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ, ওই হোমিওপ্যাথির সূত্র তাদেরকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য তো থেকেই যাচ্ছে।