রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : যৌন হয়রানি হয় নালিশ হয় না

0
85
Print Friendly, PDF & Email

যোবায়ের শাওন

– পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন বিষয়ক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলো এড়িয়ে যেতে চায়
– প্রচুর নিপীড়নের ঘটনা অহরহই ঘটছে; কিন্তু নানা কারণে সেগুলো ঠিক অভিযোগ আকারে কমিটির কাছে আসছে না
– কমিটি কতটা গোপন রেখে কাজটা করতে পারবে সে সংক্রান্ত আস্থা তৈরি হতে তো সময় লাগে
– বিষয়টা মিথ্যে হলে অভিযোগকারিণীর বিরুদ্ধেও শাস্তি হওয়া উচিত
– বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষের কোনো শিক্ষকের কিংবা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কমিটির কাছে কোনো অভিযোগ যায়নি
– প্রশাসনের পরিবর্তন মানে কমিটিরও রদবদল, পরিবর্তন
– অনেক ঘটনাই জানছি কিন্তু কিছু শর্ত পূরণ করতে না পারায় কিছুই করতে পারছি না
– তদন্ত পরিচালনা ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আরও কম প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে

যৌন হয়রানির দায়ে গত ডিসেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক শাওন উদ্দিনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫০তম সিন্ডিকেট বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রেণীকক্ষে ছাত্রীদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করায় শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটির কাছে শাওন উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত সাপেক্ষে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটি নৈতিক স্খলনের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা ২০১০’ অনুযায়ী ওই শিক্ষককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করে। ওই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট শাওন উদ্দিনকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়।
এর আগে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক জুলফিকারুল আমীনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা হয় ২০১২ সালে। যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটি অভিযুক্ত শিক্ষককে আট বছর মেয়াদে ৩ ধরনের শাস্তির সুপারিশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ওই শাস্তি প্রদান করে।
আট বছর মেয়াদি শাস্তির মধ্যে ৩টি ধরন ছিলÑ এক. জুলফিকারুল আমীন অভিযোগকারী ওই শিক্ষার্থীর কোনো শিক্ষাবর্ষেই পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো কাজে কখনোই যুক্ত হতে পারবেন না।
দুই. তিন বছর তিনি বিভাগের কোনো শিক্ষার্থীর পরীক্ষা ও গবেষণা তত্ত্বাবধানের কোনো কাজ ও একই মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকতে পারবেন না।
তিন. পাঁচ বছর তিনি বিভাগের কোনো ছাত্রীর ইন্টার্নশিপ বা গবেষণা তত্ত্বাবধানের মতো কোনো কাজ করতে পারবেন না।
এছাড়া ছাত্রীকে গানের প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় যৌন হয়রানির দায়ে টিএসসিসির প্রশিক্ষক সানোয়ার হোসেনকেও বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সাইদুর রহমানকেও শাস্তির সুপারিশ করে কমিটি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সালের জুন মাসে কার্যক্রম শুরু করে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটি। কমিটি কার্যক্রম শুরুর পরে বর্তমান সময় পর্যন্ত যৌন হয়রানির বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটলেও কিছু শর্ত পূরণের অভাবে কমিটি সব কয়টি অভিযোগের প্রেক্ষিতে কাজ করতে পারেনি। কিছু অভিযোগ আবার যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটি পর্যন্ত আসতেও পারেনি। বর্তমান কমিটির সদস্যসচিব প্রফেসর ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা এই যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন বিষয়ক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলো এড়িয়ে যেতে চায়। আর সেই সুযোগটাই নিতে থাকে কিছু স্বার্থান্বেষী বিকৃত রুচির শিক্ষক কর্মকর্তারা। তাছাড়া এখন পর্যন্তও সবাই এই কমিটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলেছি প্রকাশনা দপ্তর থেকে প্রতিবছর নবীন বরণের সময় নতুন শিক্ষার্থীদের নীতিমালার একটা করে কপি সরবরাহ করতে। এছাড়া আরও কিছু পদক্ষেপের বিষয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি।

যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা ২০১০
দেশে যৌন হয়রানি এবং নিপীড়ন রোধে প্রচলিত আইন অপ্রতুল ও সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় আইনের ফাঁক গলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। বিচার বঞ্চিত হচ্ছে বিচারপ্রার্থীরা। আইনে বিচারপ্রার্থীর তথ্য গোপন না থাকায় নিপীড়নের শিকার হয়েও অনেকে মামলা করছেন না অথবা মামলা করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না তাদের। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে গত ১৪ মে ২০০৯ সালে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের দিকনির্দেশনা দেয়। ওই রায়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণে দিকনির্দেশনামূলক সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়।
ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১০ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ‘যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ আইন-২০১০’ শিরোনামে একটি আইনের খসড়া তৈরি করে। তখন খসড়াটি মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। প্রস্তাবিত খসড়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।
হাইকোর্টের রায়ের বেশ পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা ২০১০’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩৭তম সিন্ডিকেট সভা ২৭ জুন ২০১১ সালে অনুমোদন করে। ২০১১ সালেই যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটি কার্যক্রম শুরু করে।

কার্যক্রম শুরু হলেও থাকছে প্রতিবন্ধকতা
ফোকলোরের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘হাতেগোনা দু একটি অভিযোগ যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটির কাছে আসছে বলে আমার মনে হয়, এর বাইরেও প্রচুর নিপীড়নের ঘটনা অহরহই ঘটছে; কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেগুলো ঠিক অভিযোগ আকারে কমিটির কাছে আসছে না।’ গত তিন বছরে কমিটি যৌন হয়রানির মোট পাঁচটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করতে পেরেছে। এগুলোর বাইরেও যে শিক্ষার্থীরা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন না এমনটা বলা যায় না। যদিও অভিযোগ কমিটি সর্বোচ্চ গোপনীয়তার নিশ্চয়তা নিয়েই বসে আছে। তবু ভরসা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। এই ভরসার কিংবা আস্থার পরিবেশ যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটিকেই নিতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের বিভিন্ন শ্রেণীর দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিতে হবে। বর্তমান সময় পর্যন্ত যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেল তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেননা শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই এখন পর্যন্ত এই কমিটির কার্য পরিসর সম্পর্কে জানে না। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত শিক্ষক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনাটাকে অনেকেই ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্য নেতিবাচক বলে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষক কর্মকর্তাদের প্রভাবের কাছে শিক্ষার্থীদের নিচু হয়ে থাকবার কারণ আর যাই হোক একদিনে তৈরি হয়নি। নারী অধিকার কর্মী প্রফেসর ড. মাহবুব কানিজ কেয়া বলেন, ‘আমাদের সমাজে এই ধরনের অভিজ্ঞতা লুকিয়ে রাখতে অভ্যস্ত, আমাদের সমাজও এটাকে চাপা রাখবার ব্যাপারটিকে সমর্থন করে; তাছাড়া এটা প্রকাশ হলে এর একটা সামাজিক চাপ মেয়েটার ওপরও পড়ে। আর কমিটি কতটা গোপন রেখে কাজটা করতে পারবে সে সংক্রান্ত আস্থা তৈরি হতে তো সময় লাগে। একদিনে তো আর সম্ভব নয়।’
নানা কারণেই যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন কমিটি কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে।

গোপনীয়তার সঙ্গে শিক্ষক বাঁচানো কৌশল
গত ৩ বছরে বিভিন্ন বিভাগে (বিশেষ করে সমাজকর্ম, ব্যবস্থাপনা, ফোকলোর, গণযোগাযোগ, সমাজবিজ্ঞান) ভুক্তভোগীরা বিভাগের সভাপতি বরাবর অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ পেয়ে বিভাগের ‘মান ইজ্জত’ বাঁচাতে একাডেমিক কমিটির মিটিং ডেকে অথবা অনানুষ্ঠানিক মিটিং এর মাধ্যমে অভিযুক্ত শিক্ষককে বিভাগের অভ্যন্তরীণ শাস্তি প্রদান করেছে অথবা অভিযুক্তের সঙ্গে ব্যাপারটা ‘মিটিয়ে’ নেয়ার জন্য অভিযুক্তকে তাগাদা দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিভাগের সভাপতি এবং প্রভাবশালী শিক্ষকদের একটা বড় ভূমিকা থাকছে।
ব্যবস্থাপনা বিভাগে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের দুটি ঘটনা বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা মারফত জানা যায়। একটা হলো শিক্ষক জহুরুল আনিস জুয়েলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ। অভিযোগকারী নারী একইসঙ্গে ধর্মান্তরিতকরণ ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্কের অভিযোগ তোলেন। সে সময় মহিলা পরিষদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপিও দেয়া হয়। পরবর্তীতে ভুক্তভোগী মেয়েটি কোনো রকম চাপের কথা স্বীকার না করে অভিযোগ তুলে নেন।
এই বিষয়টি যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেলের কাছে অভিযোগ আকারে তোলা হয়নি। অন্যটি শিক্ষক শাওন উদ্দিনের। শাওন উদ্দিনের বিরুদ্ধে যখন শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন; তখন প্রথমত বিষয়টিকে বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিভাগেই সমাধানের মতামত দেন বিভাগের সকল শিক্ষক এবং অভিযুক্তকে শাস্তিও দেয়া হয়। শুধু একজন শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘বিভাগীয় স্বার্থে ঘটনাটির বিভাগেই সমাধানের সিদ্ধান্ত আদালত অবমাননার শামিল।’ তিনি যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেলের কাছে অভিযোগ প্রেরণের আর্জি জানান। পরে এটি কমিটির কাছে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু জহুরুল আনিস জুয়েলের বিষয়ে কিংবা ঐ শিক্ষার্থীর অভিযোগের পক্ষে কেউই কোনো কথা বলেন না। পরবর্তীতে মেয়েটি অভিযোগ তুলে নিলেও জহুরুল আনিসের মা উপাচার্য বরাবর ছেলের কর্মকাণ্ডের জন্য স্মারকলিপি দিয়েছেন বলে জানা যায়।
এ ব্যাপারে কথা হয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের সভাপতি সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মেয়েটা জহুরুল আনিসের বিরুদ্ধে করা তার অভিযোগ তুলে নিয়েছে, আর উপাচার্য মহোদয় বরাবর তার মা একটা স্মারকলিপি দিয়েছে বলে আমি জানি; আমাকে বিষয়টি অবগত করার জন্য স্মারকলিপির একটা কপি দিয়েছে। কিন্তু আমার বরাবর কিংবা বিভাগ বরাবর কোনো স্মারকলিপি আসেনি। তাই এ ব্যাপারে আমাদের ব্যবস্থা নেয়ার কথা নয়।’ দুটো অভিযোগই বিভাগে সমাধান করার বিষয়ে বললে তিনি বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম মিটমাট করে দিতে। কমিটির ব্যাপারে জানতাম কিন্তু বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করেই আমরা এটা চেয়েছিলাম। ’
মেয়েটা চাপে পড়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উল্টোও তো হতে পারে; আমি তার সরাসরি শিক্ষক, আমার আন্ডারে মেয়েটা কাজও করেছে তাহলে আমি বিভাগের সভাপতি অথচ আমি কিছুই জানতে পারলাম না। আর বিষয়টা মিথ্যে হলে অভিযোগকারিণীর বিরুদ্ধেও শাস্তি হওয়া উচিত।’

কমিটির অস্তিত্ব জানলেও কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত নয়
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি রকি আহসান বলেন, ‘যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে এটা আমি জানতে পেরেছি কিছুদিন আগে। অনেকের সঙ্গেই আমি কথা বলে দেখেছি সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই এটা জানে না। যারা জানে তারাও কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুই জানে না।’

প্রশাসনের পক্ষপাত
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী শাশ্বত সত্য বলেন, ‘এই কমিটির কার্যক্রম এখনও তেমন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তাদের সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের তথা ভুক্তভোগীদের ভেতর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হলে তদন্ত পরিচালনা ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আরও কম প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-রাজনীতিতে প্রগতিশীল শিক্ষকদেরই দুটি গ্রুপ আছে। বিগত উপাচার্য প্রফেসর আবদুস সোবাহান কেন্দ্রিক একটা গ্রুপ এবং বর্তমান প্রশাসনের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানউদ্দিন কেন্দ্রিক অন্যটি। বর্তমান সময়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটিতে যে অভিযোগগুলোর তদন্ত এবং তদন্তের প্রেক্ষিতে শাস্তির সুপারিশ হয়েছে সেগুলোর অভিযুক্তরা বিগত প্রশাসনের পক্ষের বলে অভিযোগ আছে। বর্তমান প্রশাসনের পক্ষের কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে কিংবা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কমিটির কাছে কোনো অভিযোগ যায়নি। যদিও এমন ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে। কমিটির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রফেসর ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া বলেন, ‘আমরা অভিযুক্তের দল মত নির্বিশেষে কাজ করার চেষ্টা করেছি; কারও ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে আমরা কাজ করছি না। নিপীড়ক শিক্ষক কিংবা কর্মকর্তা হলেও আমরা নীতিমালার ভেতরে থেকেই কাজ করার চেষ্টা করেছি।’

ক্ষমতা সীমিত, কার্যকারিতাও কম
যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটির কাছে অভিযোগ আসলেই কেবল তারা তদন্তের কাজ শুরু করতে পারবেন। এর বাইরে নয়। কিন্তু ভুক্তভোগীরা অনেক সময়ই অভিযোগ করার মতো সাহস দেখাতে ব্যর্থ হন। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে তারা ঘটনার ব্যাপারটি চেপে যান। কমিটি এখানে নিরুপায়। তারা জানছেন যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে কিন্তু অভিযোগ আসছে না বলে তাদের কিছুই করার থাকছে না। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমার পরিচিত এক বড় আপু মানসম্মানের ভয়ে অনার্স করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে গেছে। বিভাগের এক শিক্ষক নাম্বার বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলে তাকে শারীরিক সম্পর্কের বিষয়ে প্ররোচনা চালায়। তিনি রাজি না হয়ে একধরনের অভিমান থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কথা বললে বিপদ আরও বাড়বে বলে তিনি পড়াশোনাই বাদ দিয়ে দেন।’

কমিটি গঠন ও প্রশাসনের পছন্দ
অভিযোগ কমিটি গঠনের ব্যাপারে নীতিমালার ৫.২ এর (ক), (খ), (গ), (ঘ)তে বলা আছে, কমিটির সদস্যদের কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ, বিদেশ গমন, অসুস্থতা বা অন্য যে কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযোগ কমিটির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই উক্ত কমিটির পুনর্বিন্যাস করতে পারবেন। গ্রহণযোগ্য ও আস্থাভাজন ব্যক্তিবর্গকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই এই দায়িত্ব দেবেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত তিনজন শিক্ষক (দুইজন নারী)এর ভেতর থেকে একজন নারীকে কমিটির সভাপতি এবং অন্য যে কোনো একজনকে কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে মনোনয়ন দেবে কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ওপর নির্ভর করবে এই কমিটি। কাজেই প্রশাসনের পরিবর্তন মানে কমিটিরও রদবদল, পরিবর্তন। প্রশাসনের পছন্দমাফিক কমিটি গঠন এই কাজের একটি পদ্ধতিগত ত্রুটি। যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কমিটি স্বাধীন হলেই কেবল এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। অন্যথায় কমিটির কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।

শেষকথা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে ছাত্রীদের অহরহই যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। বিগত সময়গুলোতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন যৌন হয়রানির ঘটনা লিপিবদ্ধ থাকলে এর তালিকা দীর্ঘ হবে এটাই স্বাভাবিক। ছাত্রীদের যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের প্রধানতম অভিযোগ শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই। ক্লাস পরীক্ষা, পার্সেন্টেজ, নাম্বারসহ শিক্ষা সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ শিক্ষকদের। তাই তাদের ইচ্ছেমতো অনেকেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েও চুপ করে থাকেন। শিক্ষকরা আইনি কাঠামোর আওতায় বিবেকচালিত। বিবেক তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। সমাজের এই ন্যায্যতা মানদণ্ড অচল হলে বিপদ নেমে আসে শিক্ষার্থীদের ওপর। ২০১১ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা চালু হলে বিবেকের বদলে আইনি প্রতিষেধকের সুযোগ মেলে। শুরু হয় স্রোতের বিরুদ্ধে চলা। তবে আরও একটু সময় হলে সবাই এ ব্যাপারে আরও সচেতন হবে বলে মনে করেন দায়িত্বশীলরা। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের অসহযোগিতা ও বাধার ফলে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন সেলের কাজ করা খুব কঠিন বলে মনে করেন প্রফেসর ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া। তিনি বলেন, আমরা অনেক ঘটনাই জানছি কিন্তু কিছু শর্ত পূরণ করতে না পারায় কিছুই করতে পারছি না

শেয়ার করুন