চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্রের উৎস কী ছিল দুই দফা তদন্তের পরও তা উদঘাটিত হয়নি। মামলার দ্বিতীয় পর্যায়ের তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ দমন বিভাগ (সিআইডি)-র এসএপি মনিরুজ্জামান মনে করেন, আটক হওয়া অস্ত্রের প্রস্তুতকারক চিহ্নিত হলেও তাদের সাথে কথা বলা যায়নি। এর ফলে কীভাবে এ অস্ত্র বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করেছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তিনি জানান, তদন্তের স্বার্থে আটক হওয়া অস্ত্রের প্রস্তুতকারক চীনের নর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশন নারিনকোর সাথে আলাপ করার চেষ্টা করা হয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি। ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর আদালত মামলাটির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিলে মনিরুজ্জামানকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। ২০১১ সালের ২৬ জুন তিনি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন।
তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আগামী বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের আদালতে চাঞ্চ্যলকর এ মামলার রায় ঘোষণা হবে। মামলার ৪৪ আসামির মধ্যে আছেন- সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জমান বাবর, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)-এর সাবেক দুই মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিমসহ কমপক্ষে এক ডজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া অস্ত্র ও চোরাচালান মামলায় দুই দফা তদন্ত করা হয়। প্রথম দফায় সিআইডির এএসপি ইসমাইল হোসেন এবং পরবর্তী সময়ে এএসপি মনিরুজ্জামান অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে পেশ করেন। প্রথম তদন্তে এ বিষয়টিসহ আরো কয়েকটি বিষয় অস্পষ্ট থাকায় আদালত অধিকতর নির্দেশ দিলে দ্বিতীয়বার মামলা দুটির তদন্ত করা হয়। দুই তদন্তেই এ অস্ত্র কীভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তার কোনো তথ্য উদঘাটিত হয়নি।
অধিকতর তদন্তের কর্মকর্তা এএসপির মনিরুজ্জামান বলেন, “সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা অস্ত্র পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, এগুলো সব চীনের নর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশন নারিনকোর তৈরি।”
তদন্তের স্বার্থে অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের সাথে যোগাযোগ করা গেলে আরো কিছু তথ্য হয়ত পাওয়া যেত, উল্লেখ করেন মনিরুজ্জামান।
তিনি বলেন, “নরিনকোর সাথে যোগাযোগের জন্য আমি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে জানিয়েছিলাম, যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সম্ভব হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিঠিপত্রও দিয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে কোনো উত্তর পাইনি।’’
কেন সম্ভব হয়নি?-এমন প্রশ্নের উত্তরে মনিরুজ্জামান বলেন, “সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না। কিছু কিছু বিষয় থাকে যা সব সময় বলা সম্ভব নয়।”
অস্ত্রগুলোর প্রস্তুতকারক নরিনকো কিংবা চীনা কর্তৃপক্ষ তদন্তে অসহযোগিতা করেছে কিনা?- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বিষয়টি এমন নয় যে তারা অসহযোগিতা করেছে।”
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের সিইউএফএল জেটিতে খালাসের সময় দশ ট্রাক অস্ত্র আটক করা হয়। এরপর সব অস্ত্র আদালতের নির্দেশে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ও অস্ত্রগারে পাঠানো হয়। আটকের পরদিন পুলিশের করা সিজারলিস্ট অনুযায়ী ১০টি অস্ত্র বোঝাই ট্রাক থেকে মোট ১ হাজার ৪৬৩টি অস্ত্র ও গোলাবারুদের বিভিন্ন আকারের বাক্স পাওয়া যায়। বাক্সগুলো একটি একটি করে খুলে অস্ত্রের তালিকা তৈরি করা হয়।
নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন কমিশনার এসএম সাব্বির আলীসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অস্ত্রগুলোর তালিকা করা হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী আটক অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ৪৯৩০টি স্বয়ংক্রিয় ও আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র যার ১ হাজার ২৯০টিই একে ৪৭ রাইফেলের চাইনিজ সংস্করণ, ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৮০ রাউন্ড আগ্নোয়াস্ত্রের গুলি, ৮৪০ টি ৪০ এমএম রকেট এবং ৩০০টি রকেট লাঞ্চার, ২৫ হাজার ২০টি হ্যান্ড গ্রেনেড, গ্রেনেড ল্যাঞ্চার ২০০০ এবং বিভিন্ন অস্ত্রের ৬ হাজার ৩৬০টি ম্যাগজিন। আটক ৪ হাজার ৯৩০টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৭.৬২ এমএম টি ৫৬-১ এসএমজি ৬৯০ টি, ৭.৬২ এমএম টি ৫৬-২ এসএমজি ৬০০ টি, ৯ এএমএম সেমি অটো স্পোটিং রাইফেল ( উজি গান) ৪০০টি, টমি গান ১০০টি। ৮২-২ হ্যান্ড গ্রেনেড ২৫ হাজার ২০টি, লাঞ্চিং গ্রেনেড ২ হাজার। গুলির মধ্যে রয়েছে ৭.৬২ এমএম এসএমজির ৭ লাখ ৩৯ হাজার ৬৮০ রাউন্ড, টমি গানের ৪ লাখ রাউন্ড। রকেট লাঞ্চারের মধ্যে রয়েছে ৪০ এমএম রকেট লাঞ্চার ১৫০টি, সাইট ফর রকেট লাঞ্চার ১৫০টি এবং ৪০ এমএম রকেট ৮৪০টি। প্রতিটি আগ্নেয়াস্ত্রের জন্যই আনা হয় ম্যাগজিন। মোট ৬৩৬০টি ম্যাগজিনের মধ্যে রয়েছে দুই ধরনের এসএমজির ২৭৬০ ও ২৪০০টি, ৯ এমএম অটো রাইফেলের ৮ শ এবং টমি গানের ৪ শ।
প্রথম দফায় তদন্তে অস্ত্রগুলো “বঙ্গ বোরাক” নামের একটি বাংলাদেশি জাহাজে এ অস্ত্র এসেছে বলে ধারণা দেওয়া হলেও তাতে স্পষ্ট করে কিছু উল্লেখ করার হয়নি। অধিকতর তদন্তেও এই সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেননি তদন্ত কর্মকর্তা।
অধিকতর তদন্তের কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান এই প্রসঙ্গে বলেন, “আসলে বঙ্গ বোরাক নিয়ে অনেক খোঁজ-খবর নেওয়া হয়েছে, নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।”
এ মামলার আসামিদের মধ্যে হাফিজুর রহমান অস্ত্র খালাসের সময় গভীর সমুদ্রে ট্রলার নিয়ে উপস্থিত ছিল। এ সংক্রান্ত সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।
মনিরুজ্জামান জানান, “খালাসের তথ্যগুলো হাফিজের দেওয়া, সেও জাহাজের নাম বলতে পারেনি।”
অস্ত্রের উৎস্য সম্পর্কে অনেক কিছু এখনো অজানা থাকলেও হাফিজের দেওয়া তথ্য থেকে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, সেগুলো আসামের ইউনাইটেড লিবারেশান ফ্রন্ট অব আসাম উলফার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল। মৌলভীবাজার জেলার সীমান্ত দিয়ে সেগুলো আসামে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
আসামি হাফিজুর রহমানের জবানবন্দি থেকে জানা য়ায়, “উলফার সামরিক শাখার প্রধান পরেশ বড়ুয়ার প্রতিনিধি আসিফ গভীর সমুদ্রে জাহাজ থেকে ২টি ট্রলারে বোঝাই করা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সিইউএফএলে জেটিতে খালাস হওয়া পর্যন্ত পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেছেন।”
মনিরুজ্জামান জানান, “এই কারণে দশ ট্রাক অস্ত্র আটক ও চোরাচালান মামলার অন্যতম আসামিও পরেশ বড়ুয়া। তবে, এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। পলাতক অবস্থায় প্রথম বারের মতো তার বিচার কাজ সম্পন্ন হবে বাংলাদেশের আদালতে।