ময়লা নিয়ে নোংরা রাজনীতি

0
169
Print Friendly, PDF & Email

নগরের ময়লা-আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট একটি জায়গার জন্য দুই বছরের বেশি সময় ধরে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। কিন্তু জেলা প্রশাসন, রাজউক ও স্থানীয় সরকার বিভাগ অনুমতি দেয়নি। বাধ্য হয়ে ময়লা ফেলতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের অদূরে, লামাপাড়ায়।
এখন সিটি করপোরেশন যাতে সেখানে ময়লা না ফেলে, সে জন্য তাদের চিঠি দিতে সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ফতুল্লা থানার বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মনিরুল আলমকে নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা সাংসদ শামীম ওসমান। ১৯ জানুয়ারি সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত মাসিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সভায় তিনি ওই নির্দেশ দেন।
গত মেয়র নির্বাচনে শামীম ওসমান এক লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে পরাজিত হন। দশম জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচনে শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগ করেছেন, শহরকে পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর রাখতে ময়লা-আবর্জনা যথাযথভাবে অপসারণ জরুরি। কিন্তু রাজনীতির দুষ্টচক্র ময়লা দিয়েও এই শহরকে দূষিত করতে চাইছে। তাঁরা দাবি করছেন, করপোরেশন যাতে বর্তমান জায়গায় ময়লা ফেলতে না পারে, তার জন্য যেমন কলকাঠি নাড়ছেন শামীম ওসমান, তেমনি করপোরেশনকে ময়লা ফেলার জায়গা না দেওয়ার পেছনেও তাঁর হাত আছে।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, নগরের ময়লা ফেলা নিয়েও শামীম ওসমান রাজনীতি করছেন। তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইভীর কাছে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। এবার তিনি ও তাঁর ভাই নাসিম ওসমান দুজনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দুটি আসন থেকে সাংসদ হয়ে সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চাইছেন।
লামাপাড়ায় ময়লা ফেলা বন্ধ করতে শামীম ওসমানের নির্দেশের ব্যাপারে কুতুবপুর ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল আলম বলেন, ‘নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত সিটি মেয়রকে এ ধরনের চিঠি দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, যে মৌজায় ময়লা ফেলা হয়, তা কুতুবপুর ইউনিয়নে নয়, সিটি করপোরেশনের অন্তর্গত।’
জানতে চাইলে শামীম ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন যেখানে ময়লা ফেলছে সেটা তাদের জায়গা নয়। ময়লার কারণে খাল বন্ধ হয়ে কুতুবপুরের পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর ময়লা ফেলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের কাছে। বিদেশি খেলোয়াড়রা এলে ময়লা ঢেকে রাখা হয়। কিন্তু গন্ধ তো থেকেই যায়। টি-টোয়েন্টি ও এশিয়া কাপকে সামনে রেখে ক্রিকেট বোর্ডের লোকজন মাঠ পরিদর্শনে এসে ময়লা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা ময়লা সরানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তাই নারায়ণগঞ্জবাসীর দাবি, এখানে যেন ময়লা ফেলা না হয়।’
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে ফতুল্লার লামাপাড়ায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের পতিত জমিতে দীর্ঘদিন ধরে ময়লা ফেলছে ফতুল্লা, কুতুবপুর, কাশিপুর ও এনায়েতনগর ইউনিয়নের লোকজন ও বিভিন্ন শিল্পকারখানা। ২০০৫ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হলে তারাও সেখানে ময়লা ফেলা শুরু করে। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, কদম রসুল পৌরসভা বিলুপ্ত করে সিটি করপোরেশন গঠিত হয়। প্রশাসকের দায়িত্ব নেন সরকার নিযুক্ত যুগ্ম সচিব। বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা আগে যেসব স্থানে ময়লা ফেলত, তার আশপাশে ঘন জনবসতি গড়ে ওঠায় প্রশাসকের আমলেই সিটি করপোরেশন শহরের ময়লা লামাপাড়ায় ফেলা শুরু করে।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, নগরের গৃহস্থালি বর্জ্য দিয়ে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট ও কমপোস্ট সার তৈরি এবং বাকি আবর্জনা পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিষ্পত্তির জন্য একটি প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় ২৫ কোটি টাকার তহবিল পায় সিটি করপোরেশন। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সিটি করপোরেশন নগরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত শীতলক্ষ্যা মৌজার প্রায় ৬ দশমিক ৪২৩৭ একর ভূমি ইজারার জন্য ২০১১ সালের শেষের দিকে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করে। জেলা প্রশাসনের চাওয়া মাত্র ভূমি খালি করে দেওয়া হবে বলে সিটি করপোরেশন প্রস্তাব দিলেও জেলা প্রশাসন জমি দেয়নি। অথচ জেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় সরকারি খাসজমি অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিয়েছে।
ইজারা না পেয়ে সিটি করপোরেশন নগরের বাইরে সৈয়দপুর মৌজায় ১৪ দশমিক ৫০ একর জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়। জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়ালের সভাপতিত্বে জেলা স্থান নির্বাচন কমিটি ২০১২ সালের ৫ মার্চ ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য সুপারিশ করে। ওই সুপারিশসহ এ বিষয়ে অনাপত্তি চেয়ে রাজউকে আবেদন করে সিটি করপোরেশন। রাজউকের সচিব ২০১২ সালের ১০ অক্টোবর এক পত্রে করপোরেশনকে জানান, প্রস্তাবিত এলাকাটি ড্যাপের আওতাভুক্ত ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রিসভার কমিটিতে উত্থাপন করা হোক।
এরপর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সিটি করপোরেশন নিজস্ব অর্থে গোপচর মৌজায় ১০ দশমিক ৫০ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি কিনতে গত বছরের ২ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমতি চায়। গতকাল পর্যন্ত সে অনুমতি মেলেনি।
সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সিটি করপোরেশন এত দিন বাধ্য হয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়ামের পাশে ময়লা ফেলেছে। জনবসতির বাইরে কোনো স্থানে ময়লা ফেলার জন্য সরকারি খাসজমি ইজারা চেয়েও পাইনি। জমি কেনার অনুমোদন পেতে এখন মন্ত্রণালয়ের দিকে চেয়ে আছি।’

শেয়ার করুন