কর্মকৌশল ঠিক করতে বিএনপির হিমশিম

0
159
Print Friendly, PDF & Email

একতরফা নির্বাচনের পর প্রায় তিন সপ্তাহ চলে গেলেও পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকৌশল নির্ধারণে স্থির হতে পারেনি বিএনপি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত দলগুলোতেও এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। বলা হচ্ছে, ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন পুরোপুরি ঠেকাতে না পারার পাশাপাশি কক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারাও এক ধরনের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার জন্য কে বা কারা দায়ী দলগুলোর মধ্যে এমন আলোচনাই এখন ঘুরেফিরে উঠছে। ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা থাকলেও নতুন পরিকল্পনা গ্রহণে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আত্মসমালোচনা থেকে দলটি এখনও বের হতে পারেনি। এদিকে তূণমূলসহ দলের সবপর্যায় থেকে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের জোর দাবি উঠছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো শেষ নেই। বিএনপি শিগগিরই ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন উদ্যমে আন্দোলন শুরু করবে। আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, তা ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগকে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রহসনের নির্বাচন করতে হতো না। সারা বিশ্বে নির্বাচনও এমন প্রশ্নবিদ্ধ হতো না। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের মতে, ৫ জানুয়ারির পরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে বিএনপি একটি নতুন অধ্যায়ে উপনীত হয়েছে। তাই একদলীয় বাকশালী গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। যারা বিএনপিকে ধ্বংস করার কথা ভাবেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন বলেও মন্তব্য তার।
অবৈধ হলেও সরকারকে আমরা কিছুটা সময় দিতে চেয়েছি এমনটা জানিয়ে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, কিন্তু গ্রেফতার-নির্যাতনের মাধ্যমে সরকার যে পথ বেছে নিয়েছে তাতে শিগগিরই তাদের কঠোর আন্দোলনে যেতে হবে।
৫ জানুয়ারি বিরোধী দলবিহীন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আত্মবিশ্লেষণের জন্য এ পর্যন্ত বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি বা দলীয় অন্য কোনো ফোরামের বৈঠক ডাকা হয়নি। আলোচনা হয়নি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চায় বিএনপি। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় কেউ কেউ বলছেন, কাউন্সিলসম্পন্ন দল পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা। কারও মতে, জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গ ছাড়তে হবে। কেউ বা আবার ‘সঙ্গ ছাড়া’র এই চাপকে বিএনপির জন্য আরেকটি ‘ফাঁদ’ বলে মনে করছে। তাদের মতে, বৃহৎ দু’একটি শক্তির ইন্ধনে ক্ষমতাসীন মহল মূলত বিএনপিকে ধ্বংস করতে চায়। এরই কৌশল হিসেবে এবার বিএনপিকে একঘরে করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে হেফাজত ও জামায়াত প্রশ্নে বিএনপির নেতৃত্ব দোদুল্যমান রয়েছে। সম্প্রতি ওই দুটি সংগঠনের সঙ্গে বিএনপি যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে তাদের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তবে দলের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, জামায়াত প্রশ্নে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তাদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত জানাবে না বিএনপি।
এদিকে, সরকারকে কতদিন সময় দিয়ে আন্দোলন শুরু করা হবে- এ প্রশ্নেও সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে বিএনপি। দলের একটি অংশ কিছুদিন সময় দিয়ে ‘দম’ নেয়ার কথা বলছেন। কিন্তু আরেক অংশ এর বিরোধিতা করে বলছেন, সময় দেয়া হলে বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের ওপর সরকার দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখবে। পাশাপাশি বিদেশী শক্তিগুলোকে সরকার দেখাতে পারবে যে, বাংলাদেশে কোনো সংকট নেই।
সূত্রমতে, এ অংশটি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে নতুন নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষপাতি। অপর অংশটি নতুন করে সারা দেশে জনসভা ও রোড মার্চের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটিসহ সিনিয়র বেশ কিছু নেতা এখনও কারাগারে। ঢাকা মহানগরীসহ প্রায় সবগুলো মহানগরী জেলা ও থানা পর্যায়ের হাজার হাজার নেতাকর্মীও কারাগারে রয়েছেন। উপরন্তু এখনও সারা দেশে যৌথ অভিযান ও বন্দুক যুদ্ধের নামে নেতাকর্মীরা প্রাণ হারাচ্ছেন। গ্রেফতার হচ্ছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। অথচ এ পরিস্থিতিতে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত ও হতাশ। খালেদা জিয়া কী করছেন এ বিষয়ে দলের কোনো পর্যায়ে কোনো বার্তা নেই। কারাগারের বাইরে থাকা নেতারাও সবাই এখনও গুলশান অফিসে যাতায়াত শুরু করেননি। নেতাদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন বা অনানুষ্ঠানিকভাবে যেসব আলোচনা হচ্ছে, তাতে দলীয় অবস্থান স্পষ্ট হয়নি। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কারও মতে, জামায়াতকে সঙ্গে রাখা ভুল সিদ্ধান্ত। এ কারণেই দেশের অভ্যন্তরে সুশীল সমাজের পাশাপাশি বিদেশে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের কার্যকর সমর্থন পাওয়া যায়নি। আবার কারও মতে, জামায়াত সঙ্গে না থাকলেও একই অবস্থা হতো। বরং ‘মিলিট্যান্ট’ ফোর্স না থাকায় বিএনপিকে আরও নাস্তানাবুদ করে ছাড়ত সরকার। তাছাড়া জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচনও কিছুটা গ্রহণযোগ্য হতো বলে মনে করেন তারা।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতিকদের ওপর এতটা নির্ভর করা ঠিক হয়েছে কিনা তা নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কেউ কেউ এমনও বলছেন যে, কূটনীতিকরা ‘ধোঁকা’ দিয়ে সহিংসতা বন্ধের জন্য চাপ দিয়েছেন। কিন্তু অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচনের জন্য সেই অর্থে কার্যকর কোনো চাপ সরকারকে তারা দেয়নি। এ পরিস্থিতিতে কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী নেতাদের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি আলোচনা চলছে রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়েও। বিশেষ করে ২৯ ডিসেম্বরে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা কর্মসূচি সফল না করার ব্যর্থতা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ওইদিনের কর্মসূচি সফল না হওয়ার মধ্য দিয়েই মূলত বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করার পরে ওইদিন কোন নেতা বা কাদের অদক্ষতার কারণে ঢাকায় নেতাকর্মীদের নামানো যায়নি তা নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ চলছে। সব মিলিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করতে পারেনি বিএনপি।

শেয়ার করুন