বিশ্বমানের হতে পারছে না শাহজালাল বিমানবন্দর

0
123
Print Friendly, PDF & Email

সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক তৎপরতা সত্ত্বেও হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বমানের হয়ে উঠছে না। বিমানবন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রেখে কুড়িল ফ্লাইওভার, বনানী উড়াল সড়ক, টেক্সিওয়েসহ বাস্তবায়ন হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় একটি আন্ডারপাস-টানেল, অ্যাপ্রোচ রোড ও মিনি ওভারপাস নির্মাণের অভাবে সুফল মিলছে না।
ব্যস্ততম বিমানবন্দর সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত অল্প দীর্ঘ একটি লিংক রোড দিয়েই শত শত গাড়ি বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া করায় সেখানে যানজট নিত্য ভোগান্তির কারণ। মূল সড়কে যানজট হলে মুহূর্তেই বিমানবন্দরের ক্যানোপিসহ আশপাশের সড়ক পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিমানবন্দর জুড়েই চরম অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠার প্রায় তিন যুগেও অ্যাপ্রোচ রোড নির্মিত হয়নি। ব্যস্ততম মূল সড়কের সঙ্গে বিমানবন্দর সংযুক্ত থাকার নজির বিশ্বের আর কোথাও নেই। সর্বত্রই দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ রোডের মাধ্যমে বিমানবন্দর সংযুক্ত। এদিকে, বিমানবন্দর থেকে সদরঘাট ও গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি ও মেট্রোরেল স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অথচ ক্যানোপি থেকে বিমানবন্দর রেলস্টেশন পর্যন্ত মাত্র আড়াই শ গজ দীর্ঘ একটি টানেল গড়ে তোলার দাবি দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়িত হয়নি। অতি প্রয়োজন সত্ত্বেও নির্মাণ হচ্ছে না একাধিক ওভারপাস। এসব কারণে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন বিমানযাত্রীরা। শত শত মাইল পথ অতিক্রম করে দেশের বিমানবন্দরে নেমেই ক্লান্ত যাত্রীরা পদে পদে হয়রানি আর ভোগান্তির মুখে পড়েন।
বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণের জন্য রানওয়ের দক্ষিণ দিকের প্রায় এক হাজার ফুট সম্প্রসারণের কাজ চলছে। কিন্তু এর সঙ্গে অ্যাপ্রোচ রোডের সম্পৃক্ততা রাখা হয়নি। ফলে একমাত্র প্রবেশদ্বারটি আরও ব্যস্ত, ঘিঞ্জি এবং যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে ভিআইপি টার্মিনালের পাশ দিয়ে ছোট ছোট ওভারপাস নির্মাণের মাধ্যমে একাধিক অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন প্রকৌশলীরা।
বিমানবন্দর সংযুক্ত মেট্রোরেল : দ্রুত ও উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মেট্রোরেলের ডিপো নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে উত্তরায় রাজউকের ৪১ বিঘা জমির মালিকানা বুঝে নেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্রুত গতির বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি চালুরও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বিআরটি কার্যক্রম চলছে দ্রুতগতিতে। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, মেট্রোরেল অপারেশনের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা ও পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র পাওয়া গেছে। প্রকল্পে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা দেবে জাপান সরকারের সাহায্য সংস্থা জাইকা।
ড্যানিশ প্রকল্পের হাইস্পিড : বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তত্ত্বাবধানে বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন, নিরাপদে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন কাজ সম্প্রতি শেষ হয়। প্রকল্পগুলো হলো সাউথ টেক্সিওয়ে, হাইস্পিড টেক্সিওয়ে, নর্থ টেক্সিওয়ে ও সেন্ট্রাল টেক্সিও য়ে। এতে ব্যায় হয়েছে প্রায় ৫৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ডেনমার্কের অর্থায়নে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪৮২ কোটি টাকা। বাকি ৮৫ কোটি টাকা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের।
ঝুঁকিপূর্ণ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল-রাডার : ৩৫ বছরের পুরনো হওয়ায় চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিমানবন্দরের রাডার ব্যবস্থা। প্রাইমারি রাডার, সেকেন্ডারি রাডার, অটোমেটিক সার্ভিলেন্স সিস্টেম-ব্রডকাস্ট, ওয়াইড এরিয়া মাল্টিলেটারেশন, রিমোট কন্ট্রোল এয়ার টু গ্রাউন্ড, ভয়েস কমিউনিকেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম, মাস্টার ব্লক ও রেকর্ডিং সিস্টেম দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় বেশির ভাগই ওভারহলিংয়ের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। দ্রুত প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি রাডার স্থাপন না করলে যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে শাহজালাল বিমানবন্দরের উড়োজাহাজ চলাচল ব্যবস্থা। ফ্রান্স সরকারের অনুদানে ১৯৮৪ সালে প্রাইমারি রাডার এবং ১৯৮৬ সালে সেকেন্ডারি রাডার (১০ বছর আয়ুষ্কাল সম্পন্ন) স্থাপন করা হয়। আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় আরসিএজি (রিমোট কন্ট্রোল এয়ার টু গ্রাউন্ড) দিয়ে পুরো দেশের আকাশসীমা কভার করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ১৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে ২৯ হাজার ফুট নিচের ফ্লাইট এবং ঢাকায় আসা ১৫০ নটিক্যাল মাইল আগে ৩০ হাজার থেকে ৩৪ হাজার ফুট লেভেলের ফ্লাইটগুলো ভিএইচএফ কমিউনিকেশনে ধরা যায় না। হাই ফ্রিকোয়েন্সি (এইচএফ) যন্ত্রটি দিয়েও অনেক সময় আকাশে থাকা উড়োজাহাজের সঙ্গে সংযোগ করা যায় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বিমান চলাচলে মারাত্দক ঝুঁকিপূর্ণ। অত্যন্ত পুরনো হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় না। দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় ৫০ হাজার টাকার সরঞ্জাম কিনতে হয় ২০ লাখ টাকায়। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এভাবে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল। তারা দীর্ঘদিন ধরে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নও আটকে রাখে। তবে সম্প্রতি মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের পর এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল স্থাপন ও রাডার সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শাহজালাল বিমানবন্দরের মাধ্যমে ২০ বছরে সরকার ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আয় করতে পারবে। একই সঙ্গে দেশের আকাশপথ আরও নিরাপদও হবে।
আর্থিক চাপে কর্তৃপক্ষ : বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে বেবিচক অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বিপরীতে কর্তৃপক্ষকে এ বছরই ২৩৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। চলমান আরও সাতটি প্রকল্পের বিপরীতে মোট ১ হাজার ৫০৪ কোটি ২১ লাখ টাকার প্রয়োজন। এ ছাড়া অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনাধীন ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ১৬ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা দরকার বলে জানা গেছে। 

শেয়ার করুন