চার পথে এগোচ্ছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা, নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার, সংলাপ-সমঝোতার পথ খোলা রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করতে চায় দলটি। এ চারটি লক্ষ্য সামনে রেখেই ছয় মাসের পরিকল্পনা এঁটেছে বিএনপি। ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘুরে দাঁড়ানোর কাজও শুরু হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা সফরে বেরুচ্ছেন। সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখভালের পাশাপাশি যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে কাজ করবেন তারা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে চলমান সমস্যার সমাধান চাই। তবে সরকারকে এখন স্বৈরাচারী মনে হচ্ছে। তাই সংলাপের পথ খোলা রেখেই দাবি আদায়ে জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচির দিকে যাচ্ছি। কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা সফরে যাচ্ছেন। পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি, সরকার শীঘ্রই নতুন নির্বাচনের জন্য সংলাপ-সমঝোতায় বসবে। নইলে আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা দাবি আদায় করব।
তবে দলের অন্যতম নীতিনির্ধারক স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন অন্য কথা। তিনি জানান, সংলাপ-সমঝোতার পথ বিএনপির কাছে সব সময় উন্মুক্ত। কিন্তু তিন মাসে এ সরকার যে পরিমাণ সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে এবং ৫ জানুয়ারি কলঙ্কিত নির্বাচন করেছে, তাতে জনসমর্থনহীন এ সরকারের কাছে গণতান্ত্রিক কোনো দাবি করে লাভ নেই। গণতন্ত্র রক্ষায় প্রয়োজন কঠোর আন্দোলন। আর এ কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমেই স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে হবে। জানা গেছে, ছয় মাসের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মূল দল গোছানোর পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও চাঙ্গা করতে চায় বিএনপি। তাই খুব শীঘ্রই মহানগর বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, কৃষক দলসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন করে দক্ষ, যোগ্যতার পাশাপাশি আন্দোলনে রাজপথে সাহসী ভূমিকায় অংশগ্রহণকারীদের নেতৃত্বে নিয়ে আসা হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ের আন্দোলনে চরমভাবে বিধ্বস্ত বিএনপি যত দ্রুত সম্ভব দেশব্যাপী তার সাংগঠনিক ভিত্তি সুসংহত, স্থানীয় নির্বাচন ও জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে জনমত জোরদার করতে চায়। ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর নেতা-কর্মীদের আবারও চাঙ্গা করার পাশাপাশি নতুন উদ্যমে পথ চলতেই এ পরিকল্পনা। তবে আসন্ন উপজেলাসহ স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফলকে প্রাধান্য দিয়ে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতেই নির্ধারণ করা হবে পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি। এ জন্যই অঘোষিতভাবে হলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে এ মুহূর্তে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া মনে করেন, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান সরকার বেশি সময় টিকবে না। এমনকি কিছুতেই তা এক বছরের বেশি স্থায়ী হতে পারবে না। শনিবার রাতে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। ওই অনুষ্ঠানে কাজী জাফর আহমদের জাতীয় পার্টির যোগদানের মাধ্যমে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ১৯ দলীয় জোটে পরিণত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এক মাসের মধ্যে যুবদল, কৃষক দল ও ছাত্রদলসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গ দলের কমিটি পুনর্গঠনের ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতেও রদবদল আনা হতে পারে। কোনো কারণে জাতীয় কাউন্সিল করা সম্ভব না হলেও অন্ততপক্ষে আগামী ২-১ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় বিএনপির বর্ধিত সভা কিংবা নির্বাহী কমিটির একটি বৈঠকেরও আয়োজন করা হতে পারে। কিন্তু তার আগেই দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন মহানগর তথা বিভাগীয় শহরে জনসভাসহ আন্দোলনে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীদের এলাকাগুলো সফর করতে পারেন। খুব শীঘ্রই সাংগঠনিক সফরসূচি চূড়ান্ত করা হতে পারে বলেও জানিয়েছেন চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের সূত্রগুলো। পাশাপাশি আরও জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কূটনৈতিক ও যোগাযোগ তৎপরতা। সব কিছুর লক্ষ্য একটাই। তা হলো জনগণের অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনকে বেগবান করা। তবে অবশ্যই তা সংলাপ ও সমঝোতার পথ খোলা রেখেই করতে চায় বিএনপি। আর সে জন্যই সরকার পক্ষের সঙ্গে বিরোধী দলের সংলাপ কার্যক্রম সমন্বয়ের নির্দেশনা ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আগে থেকেই দিয়ে রাখা হয়েছে বলেও জানা যায়। তবে বিএনপি আশা করছে, এবার অন্তত সরকারের পক্ষ থেকেই সংলাপ-সমঝোতার উদ্যোগটি নেওয়া হবে। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্বাপর আন্দোলনে দলীয় নেতৃত্বের সাফল্য-ব্যর্থতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। ইতোমধ্যেই পেশাজীবীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে সেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলেছেন বেগম খালেদা জিয়া। গত বছরের শেষদিকে সারা দেশে জনসমর্থনের জোয়ার, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের উদ্যোগ ও আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ছিল পুরোটাই সরকারের বিপক্ষে। কিন্তু তারপরও চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি বিরোধী জোটের। কেন এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, তা নিয়ে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণের পাশাপাশি তা থেকে উত্তরণের নানা কৌশল প্রণয়ন করছে দলের নীতিনির্ধারক মহলের সদস্যরা। তবে একটি বিষয়ে তারা নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন- নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনে দেশব্যাপী জোরালো জনসমর্থন থাকার পরও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই আন্দোলনের ফসল তারা ঘরে তুলতে পারেননি। এ ছাড়া মামলা-হামলা, গ্রেফতার ও বিরোধী নেতা-কর্মীদের রাজপথে দেখামাত্র পুলিশের গুলি করার নির্দেশসহ সরকারের কঠোর পদক্ষেপে একপর্যায়ে আড়ালে চলে যান শীর্ষ নেতারা। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এমন আত্দরক্ষামূলক অবস্থানের সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে সরকার। সারা দেশে তৃণমূলের আন্দোলনে নেতা-কর্মীরা জীবন দিলেও কেন্দ্রীয় নেতাদের বড় অংশটিই গা বাঁচিয়ে চলেছে আন্দোলনের পুরোটা সময়। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরসহ দেশের অনেক জেলা ও উপজেলায় এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেখানে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারেনি। অন্যদিকে মূল্যায়ন বঞ্চিত নেতা-কর্মীদের একটা বৃহৎ অংশই ছিল নিষ্ক্রিয়। এ ছাড়া অব্যাহতভাবে দমন-পীড়নসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সহযোগিতায় যৌথবাহিনীর অব্যাহত অভিযানের শিকার তৃণমূল নেতৃত্বও হয়ে পড়ে চরমভাবে বিপর্যস্ত। বিএনপি স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী রাজনীতির বিপক্ষে গেলেও বর্তমান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রুত সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন দিতে বাধ্য করতে জনসমর্থন আরও জোরালো করার কোনো বিকল্প নেই ১৯ দলীয় জোটের সামনে। আর সেই জনসমর্থনকে নতুন করে চাঙ্গা করতেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। প্রতিটি উপজেলায় একক প্রার্থী দিয়ে তাকে সবাই মিলে সমর্থন দিতে দলের সিনিয়র নেতাদের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যে দলীয় সমর্থন নিয়ে প্রার্থীরা আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী কার্যক্রমও শুরু করে দিয়েছেন। স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল অনুকূলে এনে সরকারকে বিএনপি আবারও দেখিয়ে দিতে চায় জনসমর্থন এখনো তাদেরই পক্ষে।