ফিলিপিনো এক নাবিক ষোলো মাস ধরে সেইল করছে। এই দীর্ঘ সময় ঘরের বাইরে থাকলেও ঘরের কোনো কাজই তার জন্য আসলে থেমে থাকেনি। এমনকি লক্ষী বউটি তাকে ছাড়াই সন্তান জন্মদানের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে ফেলেছেন।
এই মারাত্মক খবর জানার পরও স্ত্রীর কাছ থেকে কোনো কৈফিয়ত তলব করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ শ্যালকদের সবাই এলাকার মাফিয়া। শুভ সংবাদের সাথে সাথে শ্যালকদের হুমকির অশুভ সংবাদও এসেছে। ওদের বোনের সাথে কোনো ধরনের ‘চুদুরবুদুর’ করলে পুরো হাড্ডিগুড্ডিসহ নাকি কিমা বানিয়ে ফেলবে। মাফিয়াদের রাজ্যে মায়ের পেটে মাত্র ষোলো মাস কেন- দরকার পড়লে সন্তান ষোলো বছরও থাকতে পারে। এখন এটাই তাকে মানতে হবে।
কাজেই এই নাবিক অধিক শোকে পাথর না হয়ে খানিকটা তরল হয়ে পড়েন। এই শুভ সংবাদ সেলিব্রেট করার জন্য এক পার্টির আয়োজন করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অন্যান্য নাবিক বিষয়টি জেনে কেউ ধাক্কা খায়, কেউ পুলক অনুভব করে। কেউ কেউ আবার রসালো বিষয়টি নিয়ে টিকা-টিপ্পনি কাটে। এরশাদের কোনো কথা তুললে ফিরোজ রশীদরা লজ্জা না পেয়ে যেভাবে উৎফুল্ল হয়ে জবাব দেন, একই ভঙ্গিতে এই নাবিকও সহকর্মীদের সব টীকা-টিপ্পণীকে উপভোগ বা কাউন্টার করেছেন। থুথু বাবার শেষ কথার মতো এখানেও শেষ কথাটি হলো, সন্তান যারই হোক- বউটি তো তার নিজেরই।
এই হতভাগা নাবিকের মতো অনেকটা একই রকম জটিলতায় পড়েছে আমাদের হতভাগা দেশটি। ষোলো মাস ধরে নাবিকটি স্ত্রীর সান্নিধ্যে না গেলেও বউয়ের সন্তান হয়ে গেছে। তেমনিভাবে ১৫৩টি সিটের ভোটারেরা ভোট না দিলেও তাদের এলাকার এমপিরা ঠিকই নির্বাচিত হয়ে পড়েছেন। প্রাণপ্রিয় বউটির হাতটি একটু ধরার মতো ব্যালটের কাগজটিতেও হাত রাখতে পারলেন না প্রায় পাঁচ কোটি ভোটার। মাফিয়া শ্যালকদের মতো আবার এক দাদা এই জারজটিকেই বুকে তুলে নিতে এই জাতির প্রতি চোখ রাঙাচ্ছেন। বিভিন্ন কসরত কায়দা করছেন। উপদেশ আর টাকার থলি নিয়ে হাজির হয়েছেন।
বাকি ১৪৭ জন এমপি ষোলো মাসের গর্ভের মতো ভয়ঙ্কর না হলেও কমপক্ষে বারো মাসের গর্ভের মতো বেদনাদায়ক ঠেকেছে। ১৪৭ সিটে ভোট পড়েছে ১০ শতাংশেরও অনেক কম। ৫০টির বেশি কেন্দ্রে একজন ভোটারও ভোট দিতে যাননি। ৯ কোটি ভোটারের মধ্যে হিসাব টানলে দেখা যায় সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৪ শতাংশ ভোটারের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে এই সরকার। তার পরও এই ‘আজব’ সন্তানকে নিয়ে সরকারের আহাদ ও তৃপ্তির সীমা নেই। যে মুরব্বিরা গত ২৮ ডিসেম্বর এই ‘জারজ’ সন্তান পয়দা না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তারাও শেষমেশ এই সন্তানের একটা ‘নেক’ নাম রাখার সুপরামর্শ দিয়েছেন। তারাও এক ফাঁকে ভালো ভালো লোকগুলোকে মন্ত্রী বানানোর পরামর্শ দিয়েছেন। হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশের মুরব্বিকুল!
ষোলো মাস বাড়ির বাইরে থাকলেও এই নাবিককেই হতে হবে এই সন্তানের অফিসিয়াল বাবা। এ বিষময় পিতৃত্বের ভারের মতোই একটি অবৈধ সরকারের ভার জাতিকে বহন করতে হচ্ছে।
আওয়ামী বলয়ের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের বেশ কিছু সেন্সর নষ্ট হয়ে গেছে। তারা মনে করে বিশ্ববাসী ও দেশের মানুষের সেন্সর তাদের মতোই ত্রুটিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক মুখপাত্র এ সরকারের ব্যাপারে হতাশা থাকলেও কাজ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ কথার মাধ্যমে তারা সরকারকে স্বীকৃতি দেননি বরং অস্বস্তিসহকারে বাস্তবতা (Uneasy acceptance) মেনে নিয়েছেন। আওয়ামী প্রাণ মিডিয়া এতেই আর্কিমিডিসের মতো ন্যাংটা হয়ে ইউরেকা, ইউরেকা বলে দৌড়ানো শুরু করে দিয়েছে। এমনভাবে প্রচারণা চালিয়েছে যাতে মনে হবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছে।
এসব বুদ্ধিজীবীর ইংরেজি জ্ঞানের অভাব নাকি অন্য কিছুর অভাব, তা বোধগম্য হচ্ছে না। বিদেশী রাষ্ট্র বা সংস্থা মন্তব্য করে এক দিকে, এরা তার অর্থ টেনে নিয়ে যান অন্য দিকে। হিলারি কিনটন টেলিফোনে ধমক দিলে বাইরে এসে বলে, ম্যাডাম বহুত প্রশংসা করেছেন। এতে হতাশ হয়ে সেই টেলিফোন সংলাপটিই লিক করে দেয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলো এ সরকারের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে অনেক কথাই বলেছে। বাকশালবান্ধব মিডিয়া সেসব কথা জনগণকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি।
কিন্তু কোনো মন্তব্য তাদের মতের কাছাকাছি হলেই ইউরেকা বলে লাফিয়ে পড়ে। মন্তব্যটিকে একটু এ দিক সে দিক করে পুরোপুরি নিজেদের মতো করে প্রচার করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমান সরকারের ব্যাপারে উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেছে। সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার কথাও এ বিবৃতির এক জায়গায় রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা (Political violence) এবং বর্ণিত এই সন্ত্রাসের (Terrorism) মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আওয়ামী বলয়ের কূটনীতিকেরা তাদের স্বভাবসুলভ চালাকিতে এর অর্থ করেছে, ইইউ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে বলেছে। অথচ সেই বিবৃতির কোথাও জামায়াতের নাম উল্লেখ ছিল না।
বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশ এই অবৈধ সরকারকে নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করলেও প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছে সরকারের বিশেষ কুটুম ইন্ডিয়া। অন্যান্য অভিনন্দন বার্তা প্রেরণকারীর মধ্যে উত্তর কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দনটিও বিশেষ অর্থবহ ও কৌতুকময়। কারণ মনের মতো বন্ধু পেলে সবাই খুশি হয়। উত্তর কোরিয়াও তাদের মতো আরেকটি সরকারের পদধ্বনি পেয়েছে। তালিকাটি এতই করুণ যে রাজনীতির জগৎ থেকে অনেক দূরে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থার প্রধানের অভিনন্দন বার্তাটিও বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়েছে।
তার পরও সরকার ও তাদের বুদ্ধিজীবীকুলের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। এমপিদের শপথ অনুষ্ঠানের পর মন্ত্রিপরিষদও গঠন করা হয়েছে। সেই সরকারের চেহারা দেখে মনে হয়েছে কবিগণ অনেক আগেই বলে ফেলেছিলেন, উদ্ভট এক উটের পিঠে চলিছে স্বদেশ। এরশাদের চেহারার ত্রিশ ভাগ না দেখেই কামরুল হাসান বলেছিলেন বিশ্ববেহায়া। সেই এরশাদ অনেক সার্কাসের পর শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হয়েছেন। এতে অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। তবে অবাক করা খবর হলো এই এরশাদ আবারো সাংবাদিকদের সামনে হাজির হওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। এগুলো নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে যত সমালোচনা হোক না কেন সরকারের তুষ্টি হলোÑ মানির মান আল্লাহ রেখেছে।
মনিকা লিউনেস্কি নামক ফাটা বাঁশে আটকা পড়ে জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে সরাতে কিনটন সুদানের ওষুধ ফ্যাক্টরিকে সন্ত্রাসীর আস্তানা মনে করে হামলা চালিয়েছিল। মিডিয়া এর নাম দিয়েছিল মনিকা মিসাইল। একইভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের পুরনো প্রচারণা নিক্ষেপ করে এ সরকার তার বেকায়দা অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছে।
আওয়ামী লীগ ও তার প্রপাগান্ডা মেশিনের জন্য দুঃসংবাদ হলো যে মানুষ এখন তাদের ধারণার চেয়েও বেশি সচেতন হয়ে পড়েছেন। কোন ঘটনায় কে বেশি বেনিফিশিয়ারি হচ্ছে তা সঠিকভাবে বের করার বিশ্লেষণী ক্ষমতা জনগণ আয়ত্ত করে ফেলেছে। জনগণের চোখ খোলা থাকায় অনেক জায়গায় এ ধরনের মিশনে ধরা পড়েছে আওয়ামী লীগ বা তার কোনো অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। কাজেই অনেক দুর্বল চিত্রনাট্য নিয়ে রচিত সরকারের পুরো পরিকল্পনা বুমেরাংও হয়ে পড়েছে।
এসব কাজের মাধ্যমে সারা বিশ্ব থেকে দেশটিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে এ সরকার। একমাত্র ভরসা এখন ইন্ডিয়া। সেই ইন্ডিয়া যেকোনো মূল্যে তাদের নিজের দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর। এমনকি শিবসেনা, বিজেপির মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক দল ক্ষমতায় চলে এলেও তারা গণতন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু চিন্তা করে না। কারণ তারা ভালোভাবেই জানে যে, কোনো দেশের গণতান্ত্রিক ধারা টিকিয়ে রাখতে পারলে বিজেপি-শিবসেনার মতো দল নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু থাকে না। কারণ তারা যেভাবে ক্ষমতায় আসতে পারবে একইভাবে ক্ষমতা থেকে চলে যেতেও বাধ্য হবে। কাজেই তাদের সর্বোচ্চ মনোযোগ বিজেপি-শিবসেনার ধ্বংস নয়। তাদের সর্বোচ্চ মনোযোগ থাকে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখা।
কিন্তু সেই একই ইন্ডিয়া আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিন্তাভাবনা করে। বিজেপি যাদের দেশে সুনিশ্চিতভাবে পরবর্তী সরকার গঠন করছে সেই ইন্ডিয়া আমাদের দেশের জামায়াতকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমাদের সুশীলসমাজের একটা অংশের উদ্বেগও ইন্ডিয়ার উদ্বেগের কার্বন কপি। এই জামায়াত জুজুর ভয় দেখিয়ে দেশের গণতন্ত্রকে ইতোমধ্যেই তারা হত্যা করে ফেলেছে। যদিও জামায়াতের এককভাবে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা এ দেশে এখনো সৃষ্টি হয়নি। এখনো বিএনপির নেতৃত্বাধীন শুধু একটি জোটে তারা রয়েছে। মূল কথা হলো, গণতন্ত্র নামক আঙুর বিভিন্ন ছলচাতুরির মাধ্যমে ইন্ডিয়া আমাদের জন্য অধরাই রাখতে চায়। নিজে যে গণতন্ত্র উপভোগ করে, তা থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে চায়।
কারণ এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়লে এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ১৯৯০ সালের পর থেকে গণতন্ত্রের যাত্রার সাথে সাথে অর্থনৈতিক উন্নতিও চোখে পড়ার মতো। একক জাতিসত্তা বা সিঙ্গেল ইউনিটের এই রাষ্ট্র এগিয়ে গেলে তা দেখে ইন্ডিয়ার ভেতরের বিভিন্ন জাতিসত্তা আলাদা হওয়ার জন্য উৎসাহিত হয়ে পড়তে পারে। কাজেই ইন্ডিয়ার চার পাশের ছোট দেশগুলো স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বেড়ে উঠুক এটি ইন্ডিয়া চায় না। ইন্ডিয়ার এ পলিসির কারণে কোনো প্রতিবেশীর সাথেই তাদের সুসম্পর্ক নেই। পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপালের জনগণও তাই চরম ইন্ডিয়াবিদ্বেষী হয়ে পড়েছে।
তবে এ দেশে ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় সফলতা হলো রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জগতে বিশাল দালাল শ্রেণী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। একটি দলে বেশি থাকলেও অন্যান্য দলেও এদের অস্তিত্ব রয়েছে। ষোলো কোটি লোকসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটির জনগণের ভবিষ্যৎ নিয়ে এরা মোটেই চিন্তিত নয়। এরা শুধু মনিবের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। এ দেশে খুদকুড়া (ইকোনমিস্টের মতে উপদেশ ও টাকার থলি) ছিটিয়ে অনেক টিয়াপাখি সৃষ্টি করেছে। এরা একই কথা অনর্গল বলতে বলতে বা লিখতে লিখতে পুরো জাতিকে বিভ্রান্ত করে ছাড়ে।
এ মুহূর্তে দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তাটি হলো ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যার বিষয়টি; কিন্তু এ টিয়াপাখিদের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জামায়াত। এরা ভালোভাবেই জানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে অন্য কোনো নামে তারা আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবে। এদের মূল চাওয়াটি হলো, জামায়াত এভাবেই কিছু দিন লটকে থাকুক। জামায়াত ইস্যু নিয়ে বিএনপিকে বিভ্রান্ত ও হতাশ করে হয় আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে নিয়ে আসতে বাধ্য করবে অথবা বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে এক ধরনের টেনশন সৃষ্টি করে বর্তমান সরকার টিকেই যত দিন সম্ভব টেনে নেবে। কাজেই বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য আজব আজব বিশ্লেষণ দিয়ে সংবাদ ছাপাচ্ছে। পেছনের উদ্দেশ্য একটাইÑ এই দু’টি দলের মধ্যে যেভাবেই হোক দূরত্ব সৃষ্টি করা। এই পরিকল্পনায় সফল হলে তিনটি জিনিস থাকবে না অথবা মৃতপ্রায় হয়ে পড়বে। এক বিএনপি, দুই জামায়াত, তিন বাকশালের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো কোনো কার্যকর বিরোধী দল। অন্য দিকে বিকল্প পথে বা আধিপত্যবাদী শক্তিকে তোয়াজ করে যে বিএনপির স্বপ্ন কেউ কেউ দেখছেন তা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার বিএনপি হবে না। হবে অন্য কিছু। সেই ‘অন্য কিছু’ একূল ওকূল দু’কূলই হারাবে।
আজ জামায়াত যদি আঠারোদলীয় জোট ত্যাগ করে তখন জামায়াতের সাথে সখ্য করতে এই আওয়ামী লীগ একটুও লজ্জা পাবে না। বর্তমান একদলীয় শাসন টিকিয়ে রাখতে জামায়াতের প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য সহযোগিতা নিতে তারা সামান্য দ্বিধা করবে না। আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদী রাজনীতির সাথে যাদের পরিচয় আছে, তারা কখনোই এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবেন না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যদি সামান্য টানাপড়েনও সৃষ্টি করতে পারে, তখন আওয়ামী লীগের কেল্লাটি সত্যি সত্যি ‘ফতেহ’ হয়ে পড়বে। তখন সামনের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা বর্তমান অবৈধ সরকারের পক্ষেও কঠিন হবে না।
সরকার এই কাজে সফল হতে পারলে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোও একসময় নীরব হয়ে পড়বে। সরকারের প্রচারণার বিপরীতে এ বিষয়গুলো দেশের মানুষকে এবং বিশ্বের শান্তিকামী ও গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিগুলোকে বোঝাতে হবে। ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক উগ্রতা প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় প্রতিষেধকটি হলো উদার গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র পুনঃরুদ্ধারের কঠিন দায়িত্বটিই চেপেছে এখন বিএনপির কাঁধে। এ সময় বিএনপিকে তার কর্তব্যকর্ম থেকে বিভ্রান্ত এবং লক্ষ্যচ্যুত করার অর্থ হবে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় উগ্রবাদকে আরো এগিয়ে আনা। ধর্মীয় উগ্রবাদ নয়Ñ এই মুহূর্তে দেশের বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ। দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে এক হয়ে এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেই আগে লড়তে হবে।
মনে রাখতে হবে আঠারোদলীয় জোটের প্রধান দল বিএনপি। এই জোটে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তারা বিএনপির মডারেট নীতি আদর্শের নেতৃত্ব মেনে নিয়েই অংশগ্রহণ করেছেন। কাজেই জোটের শরিক কোনো দলের নীতি-আদর্শ বিএনপিকে মানার প্রশ্নই ওঠে না। যারা এটা বলছে, তারা বর্তমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য এটা বলছে। আজ যারা জামায়াতকে ত্যাগ করার জন্য বিএনপির প্রতি নসিহত করছে এই মুন্সীরাই ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মহা আগ্রহে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির সাথে বিচ্ছেদের পর (যদি হয়) এই মুন্সীরাই আবার আওয়ামী লীগ-জামায়াতের হিল্লাটিও পড়াবে।
বিএনপি জামায়াতকে ছাড়লেও ‘হাসিনা-এরশাদ’ জুটি এই জামায়াতকে আবারো কাছে টেনে নেবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ এ দেশের রাজনীতিতে অবিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে আছেন হাসিনা-এরশাদ জুটি। তারা যখন কোনো কথা বলেন, তখন মনে হয় এটিই তাদের জীবনের শেষ কথা। এ রকম অনেক অভিজ্ঞতা এই জাতির হয়েছে। ১৯৮৬ সালে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন, এরশাদের অধীনে যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন তারা জাতীয় বেঈমান হিসেবে গণ্য হবেন। এই ঘোষণার এক দিন বা দু’দিন পরে তিনিই প্রথম নিজের ঘোষিত সেই জাতীয় বেঈমান সেজেছিলেন। তখন সঙ্গী করেছিলেন এই জামায়াতকে।
আজ একদলীয় শাসন যখন জাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে তখন সব গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অতীব জরুরি। এই মুহূর্তে দরকার গণতন্ত্রের জন্য চলমান আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী ও বেগবান করা। জামায়াতে ইসলামী গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে কাজ করছে। কাজেই তাদের নিষ্ক্রিয় করা বা অগণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে কাজ করতে ঠেলে দেয়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের সব গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য কখনোই ভালো রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে না।
এই দেশের প্রতি এবং দেশের গণতন্ত্রের প্রতি দরদ রয়েছে এমন কাউকে এই কথাগুলো দ্বিতীয়বার বুঝিয়ে বলার দরকার পড়বে না। কাজেই বিশেষ প্রজাতির টিয়া পাখিরা কী বলছে তা নয়, দেশের জনগণের মনের কথাটিই বেশি বেশি পড়া দরকার। এই পড়ায় সামান্য ভুল করলে জাতির সেই ক্ষতি আর পূরণ হওয়ার মতো থাকবে না।