সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চিঠি এজাহারের বাইরের আসামি ধরতেই পুলিশের আগ্রহ

0
80
Print Friendly, PDF & Email

যশোরের অভয়নগর এবং দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও সদরের কয়েকটি গ্রামে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছে, এদের মধ্যে এজাহার-ভুক্ত আসামির সংখ্যা অত্যন্ত কম।
ওই তিন এলাকা পরিদর্শন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সরকারের সংশ্লিষ্ট তিন মন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে এ কথা জানিয়েছে। পৃথক তিনটি চিঠি দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী (এলজিআরডি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে। কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, কিছু কিছু মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এভাবে সন্দেহভাজন আসামি গ্রেপ্তারকে ‘স্রেফ ব্যবসার জন্য’ এবং ‘লোক দেখানো’ বলে প্রথম আলোর কাছে গতকাল রোববার মন্তব্য করেছেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আসামিদের ধরবই এমন দৃঢ় মনোভাব পুলিশের ভেতরে দেখিনি। কেবল মানুষকে বলার জন্য গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে কমিশনের প্রতিনিধিরা ৯ জানুয়ারি যশোর, ১৫ জানুয়ারি দিনাজপুর এবং ১৬ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও পরিদর্শন করেন। এসব পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ২২ জানুয়ারি চিঠিগুলো দেওয়া হয়।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে দেওয়া চিঠিতে কেবল যশোরের অভয়নগরের চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ার ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরা হয়। তবে অন্য দুই চিঠিতে তিন জেলার ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়। চিঠিতে মালোপাড়ার হামলার বিষয়ে স্থানীয় জনসাধারণের অভিযোগ উল্লেখ করে বলা হয়, পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা চেয়েও তাঁরা পাননি। ভোটের দিন সকালে কিছু লোক এসে তাঁদের (গ্রামবাসীদের) ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে যায়। বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করার পরও পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চিঠিতে বলা হয়, ভোটের আগে থেকেই পার্শ্ববর্তী বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের জামায়াত-শিবির ও বিএনপির সন্ত্রাসীরা ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য মালোপাড়ার অধিবাসীদের হুমকি দিয়ে আসছিল। নির্বাচনের দিন বেলা ১১টায় মালোপাড়ার পার্শ্ববর্তী চাঁপাতলা আলিম মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে গ্রামের কয়েকজন হিন্দু ছেলেকে মারধর করেন জামায়াতের কর্মীরা।
এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, প্রাথমিক পর্যায়ে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকায় চাঁপাতলাবাসীর নিরাপত্তা দিতে না পারলেও পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। সে কারণে গ্রাম ছেড়ে পালানো লোকজন ফিরে এসেছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, মালোপাড়ায় হামলার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হলেও এ পর্যন্ত (২২ জানুয়ারি) ১৯ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে এজাহারে নাম আছে এমন আসামি মাত্র একজন।
গতকাল অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খবির আহমেদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ওই মামলায় এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা ৩৯ জন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৯ জনকে। এর মধ্যে এজাহারে নাম থাকা আসামির সংখ্যা এক। এভাবে এজাহার ছাড়া আসামি ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে থানার ওসি (তদন্ত) মোহসিন উদ্দিন বলেন, হামলার পরপরই অনেকের নাম আসেনি। এখন তদন্ত করতে গিয়ে নতুন অনেকের নাম আসছে, তাদেরই ধরা হচ্ছে।
কমিশনের আরেকটি চিঠিতে বলা হয়, ৫ জানুয়ারি দিনাজপুর সদর উপজেলার চেগেলগাজী ইউনিয়নের ভোটকেন্দ্র কর্ণাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্বাচন প্রতিহত করতে দুষ্কৃতকারীরা কর্ণাই বাজার আক্রমণ করে। এরা বাড়িঘর, দোকানপাটে আগুন লাগানোসহ ভাঙচুর এবং ত্রাস সৃষ্টি করে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতবাড়ি ভাঙচুরসহ তাদের মালামাল চুরি ও লুটপাট করে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় দিনাজপুর সদর থানায় তিনটি মামলা করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের করা তিন মামলায় মোট ১৯৮ জন আসামি আছে বলে জানান সদর থানার ওসি (তদন্ত) শেখ হাফিজুর রহমান মুন্সী। এদের মধ্যে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর এজাহারবহির্ভূত ৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এজাহারবহির্ভূত ব্যক্তির সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি একইভাবে বলেন, মামলা করার সময় আসলে সবার নাম আসেনি। যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তা ভুক্তভোগীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
৫ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বাসুদেবপুর, গড়েয়া গোপালপুরসহ বেশ কিছু ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনায় সংখ্যালঘুদের বসতবাড়ি, দোকানপাট ভাঙচুরসহ তাদের মালামাল লুটপাট ও চুরি হওয়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে কমিশনের চিঠিতে। সংখ্যালঘুরা প্রাণভয়ে বিভিন্ন ধর্মশালা ও মন্দিরে আশ্রয় নেয়। সন্ত্রাসীরা স্থানীয় দেউনিয়া বাজার এবং আকচা পল্টন বাজারে হামলা চালিয়ে মালামাল পুড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে দেশছাড়া করার হুমকি দেয়। চিঠিতে বলা হয়, প্রশাসনের সার্বিক নিরাপত্তায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের ঘরবাড়িতে ফেরত এলেও বর্তমানে চরম নিরাপত্তার অভাব রয়েছে।
ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ খান মুঠোফোনে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পর পাঁচটি মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে দুটি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে তিনটি মামলা করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মনীন্দ্র বর্মণের মামলায় ৪১ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে প্রধান আসামি ইব্রাহীমকে গত শনিবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে তিনজনের নাম মামলায় উল্লেখ আছে, দুজন সন্দেহভাজন। ফিরোজ খান দাবি করেন, এজাহারে নাম নেই এমন আসামিদের তিনি ধরছেন না।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের এই চিঠি এখনো দেখেননি বলে গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল। তবে খোঁজ নিয়ে দ্রুত দেখবেন বলে জানান তিনি। চিঠিতে মামলার এজাহারের আসামি বাদ দিয়ে সন্দেহভাজনদের ধরার অভিযোগ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এমন অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে উঠেছে, তাদের আমরা সরিয়ে দিয়েছি।’
মূল আসামিদের না ধরার পেছনে কারণ হিসেবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আসলে সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। আর এ জন্যই এখন গুম করার কথা রটানো হচ্ছে। অতিরিক্ত লোকজন ধরা ব্যবসার জন্য—মিজানুর রহমানের এই অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটা সঠিক নয়, আমি বিশ্বাস করি না। এর পরও আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’

শেয়ার করুন