জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেও বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয় নেতারা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। মাঠপর্যায়ের এই নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় পরিচয়ের বাধ্যবাধকতা না থাকায় সব দলের নেতারাই যে যাঁর মতো অংশ নিচ্ছেন। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি ও জামায়াত এই স্থানীয় নির্বাচনে যোগ দেওয়া বা না দেওয়ার ব্যাপারে তৃণমূলকে প্রকাশ্যে কোনো বার্তা দেয়নি।
প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন গতকাল চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রায় সমান সংখ্যক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আর জামায়াতে ইসলামী ২৬ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী দিয়েছে। প্রথম দফায় ৯৭ উপজেলায় ভোট গ্রহণ হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি।
গতকাল রাত সাড়ে ১০টায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তিনটি পদে এক হাজার ৭২৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এঁদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬৯০, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬৫৬ এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩৮০ প্রার্থী।
১৯ জানুয়ারি ১০২টি উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে সীমানা জটিলতার কারণে রংপুর সদর, গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়। এর বাইরে পীরগঞ্জের ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি।
উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ও দুই ভাইস চেয়ারম্যান—এ তিনটি পদে সরাসরি ভোট গ্রহণ হয়ে থাকে। এর বাইরে সংশ্লিষ্ট উপজেলার আওতাধীন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র এবং সংরক্ষিত নারী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উপজেলা পরিষদ গঠিত হয়।
গত রাতে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৯৭টি উপজেলার মধ্যে ৪৯টি উপজেলায় আওয়ামী লীগের ১৩৪ এবং বিএনপির ১২৪ জন চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। জামায়াত, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ ছোট দল এবং স্বতন্ত্র মিলিয়ে প্রার্থী ৪৩।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর গঠিত সরকার স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের বৈধতা প্রমাণের সুযোগ পেল। পাশাপাশি বিরোধী দল বিএনপি প্রকাশ্যে কিছু না বললেও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের চাঙা করতে এই নির্বাচনে বাধা দিতে চাইছে না।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গতকাল বিকেলে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা মোশাররফ হুসাইন (ডানে) ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসগর আলী (সর্ববায়ে) । ছবি: প্রথম আলোদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানান, জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি-জামায়াতের যে ক্ষতি হয়েছে, এই নির্বাচন ঘিরে তারা তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তবে বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচনের ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে কোনো নির্দেশনা পাঠায়নি। তা সত্ত্বেও তৃণমূল নেতারা নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এমনকি জেতার জন্য বিএনপির জেলা কমিটি চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাঠপর্যায়ে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাঁদের মতে, মানুষ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হলেও একতরফা নির্বাচনে ভোটাররা সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার সুযোগ সেই অর্থে পায়নি। কারণ, ১৫৩টি সংসদীয় আসনে নির্বাচনই হয়নি। একক প্রার্থী থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেছেন তাঁরা। তাই উপজেলা নির্বাচনে মানুষ সুযোগ হাতছাড়া করবে না।
যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একক প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করবে। ফলে ভোট পড়তে পারে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। তাঁর মতে, উপজেলা পরিষদ থাকবে কি না, উপজেলা নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সেই সংশয় দূর হয়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানান, গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় দেশের কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বরিশালের গৌরনদীতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের একজন, বিএনপির চার এবং জাতীয় পার্টির একজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ভোলার লালমোহনে আওয়ামী লীগের আট ও বিএনপির তিনজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ছয় নেতার মধ্যে আওয়ামী লীগের দুজন, বিএনপির তিন ও জামায়াতের একজন প্রার্থী রয়েছেন। কিশোরগঞ্জের নিকলীতে আওয়ামী লীগের দুই, বিএনপির চার ও স্বতন্ত্র একজন; চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ১২ প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের সাত, বিএনপির তিন, স্বতন্ত্র একজন রয়েছেন।
নাটোরের সিংড়ায় আওয়ামী লীগের চার, বিএনপির দুই এবং জামায়াতের একজন প্রার্থী রয়েছেন। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াতের একজন করে প্রার্থী রয়েছেন। যশোরের অভয়নগরে চেয়ারম্যান পদে ১২ প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন বিএনপির এবং পাঁচজন আওয়ামী লীগের।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগের তিন, বিএনপির চার ও জামায়াতের একজন প্রার্থী রয়েছেন। ভেড়ামারা উপজেলায় আওয়ামী লীগের দুজন এবং বিএনপির তিনজন প্রার্থী রয়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে বিএনপির দুজন, আওয়ামী লীগের দুজন এবং জামায়াতের একজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। কুড়িগ্রামের উলিপুরে আওয়ামী লীগের চারজন, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের একজন করে প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ২৭ জানুয়ারি, প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৩ ফেব্রুয়ারি। দ্বিতীয় দফায় ১১৭টি উপজেলার নির্বাচন হবে ২৭ ফেব্রুয়ারি।
১৯৮২ সালে উপজেলা পরিষদ গঠনের পর দুবার নির্বাচন হয়ে মাঝখানে ১৮ বছর নির্বাচন হয়নি। তারপর ২০০৯ সালে নির্বাচন হয়েছে। পাঁচ বছর পর আবারও নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
হোম
স্থানীয় সরকার উপজেলা নির্বাচন ২০১৪: ৯৭ উপজেলায় ভোট ১৯ ফেব্রুয়ারি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ১,৭২৬...