ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদন : বসবাসের জন্য সবচেয়ে অযোগ্য ঢাকা রাজনৈতিক সহিংসতার কারণেই এই তকমা

0
105
Print Friendly, PDF & Email

সারা বছর অসহনীয় যানজট, গণপরিবহনের জন্য মানুষের দীর্ঘ অপেক্ষা, বেদখল ফুটপাত, সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর, ঘিঞ্জি পরিবেশ, যেখানে-সেখানে আবর্জনা, সুপেয় পানি ও গ্যাসের সমস্যা…।
ঢাকার সমস্যার তালিকা এমনই দীর্ঘ। এর সঙ্গে গত এক বছরে যোগ হয়েছে ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতা। এতে হুমকির মুখে পড়েছে নাগরিক নিরাপত্তা। এই সহিংসতাই ঢাকাকে ‘বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহর’-এর তালিকায় এক নম্বরে নিয়ে এসেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলছে, বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহর ঢাকা। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবার মান, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো—এই পাঁচটি মূল বিষয় এবং এর অধীনে ৩০টি সূচক ধরে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ১০০ পয়েন্টের সূচকে সর্বনিম্ন ৩৮ দশমিক ৭ পয়েন্ট পেয়ে সবচেয়ে অযোগ্য শহর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ঢাকা। এর আগেও ইআইইউর প্রতিবেদনে পর পর দুবার দ্বিতীয় বাস-অযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকার নাম আসে। গতবার যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক শহর ছিল তালিকায় এক নম্বরে। সিরিয়ায় তখন রাজনৈতিক সহিংসতা চলছিল। এবার সে জায়গা দখল করেছে ঢাকা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অবশ্যই রাজধানী ঢাকা ক্রমে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। তবে এবার সবচেয়ে খারাপ শহর হওয়ার মূল কারণ সহিংসতা। এক বছর ধরে ঢাকায় যেভাবে রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে, যখন-তখন যেভাবে যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে, সেসব কারণে ঢাকা হয়েছে নিরাপত্তাহীনতার এক শহর। মানুষ ছিল জিম্মি। তিনি বলেন, ‘গত বছরের শেষে আমি ঢাকার অবস্থান নিয়ে এই আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছিলাম। শেষ পর্যন্ত তাই হলো।’
ইআইইউর চলতি বছরের প্রতিবেদনটি এখনো ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গভাবে দেওয়া হয়নি। তবে গত বছরের আগস্টে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি ওয়েবসাইটে রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে স্থিতিশীলতায় ১০০ তে ঢাকার স্কোর ছিল ৫০।
স্থিতিশীলতা সূচকে বিবেচনা করা হয়েছে পাঁচটি বিষয়। এগুলো হলো: ছোট ধরনের অপরাধের উপস্থিতি, সহিংস অপরাধের উপস্থিতি, সন্ত্রাসের হুমকি, সামরিক যুদ্ধের হুমকি ও গৃহযুদ্ধের হুমকি। সাম্প্রতিক সময়ের হরতাল-অবরোধে গাড়িতে আগুন, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা—এসব কারণে এবার ঢাকার অবস্থান আরও খারাপ হয়েছে।
সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক শাহেদুল আনাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইআইইউর প্রতিবেদনে যেভাবে ঢাকাকে করাচি, ত্রিপোলি বা আলজিয়ার্সের চেয়েও খারাপ বলা হয়েছে, আমি তার সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি, ঢাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেক ভালো। তবে ঢাকা যেহেতু রাজধানী এবং গত এক বছরে ঢাকায় অনেক রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে, তাই পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হতে পারে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে এবং ছোটখাটো অপরাধ দমন করতে পারলে ঢাকা একটি জনবহুল ভালো শহরেই পরিণত হবে।’
পাঁচটি প্রধান সূচকের দ্বিতীয় মানদণ্ড স্বাস্থ্যসেবা। ব্যক্তিপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান, সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা, সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান, মাদকবিরোধী সক্ষমতা ও স্বাস্থ্যসেবার সাধারণ নির্ধারক—এই ছয়টি বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়। এ সূচকে গতবার ১০০ তে ঢাকার পয়েন্ট ছিল ২৯ দশমিক ২। এই শহরে ধনী লোকের চিকিৎসার জন্য অনেক হাসপাতাল গড়ে উঠলেও দরিদ্র মানুষের ভরসা এখনো সরকারি হাসপাতাল। আর মাদকও এই নগরের একটি সমস্যা।
তৃতীয় মানদণ্ড শিক্ষায় রয়েছে তিনটি উপাদান—বেসরকারি শিক্ষার সক্ষমতা, বেসরকারি শিক্ষার মান ও সরকারি শিক্ষার নির্ধারক। এ সূচকে গতবার ১০০ তে ঢাকার স্কোর ছিল ৪১ দশমিক ৭।
সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত সূচকে নয়টি বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে। এগুলো হলো: তাপমাত্রা বা আর্দ্রতা, ভ্রমণকারীদের (পর্যটক) কাছে আবহাওয়ার অস্বস্তিকর দিক, দুর্নীতির মাত্রা, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সেন্সরশিপ নিয়ন্ত্রণের মাত্রা, ক্রীড়ার সক্ষমতা, সংস্কৃতিগত সক্ষমতা, খাদ্য ও পানীয় এবং ভোগ্যপণ্য ও সেবা। এ ক্ষেত্রে ১০০ তে গতবার ঢাকার স্কোর ছিল ৪৩ দশমিক ৩।
অবকাঠামোগত মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে সাতটি বিষয়। এগুলো হলো: সড়ক যোগাযোগের মান, সরকারি পরিবহনের মান, আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মান, ভালো মানের বাসগৃহের প্রাপ্যতা, জ্বালানি সরবরাহের মান, পানি সরবরাহের মান ও টেলিযোগাযোগের মান। এ ক্ষেত্রে ১০০ তে ঢাকার স্কোর ছিল ২৬ দশমিক ৮।
নগর বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম বলেন, যানজট ঢাকার প্রধান সমস্যা। অথচ একটি নগরের প্রধান দিক হলো পরিবহনব্যবস্থা। ২০০৬ সালে একটি পরিবহন কৌশলপত্র নেওয়া হয়েছিল, যেটি অনুমোদিত হয়। সেখানে মেট্রোরেল, কমিউটার ট্রেন—এগুলোতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই অগ্রাধিকারে গুরুত্ব না দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইওভারের দিকে নজর দেওয়া হলো। কিন্তু ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা ঠিক করতে হলে অগ্রাধিকার অনুযায়ী গুরুত্ব দিতে হবে।
ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে বসবাসযোগ্য করার জন্য কী করা উচিত জানতে চাইলে এই নগরবিশেষজ্ঞ বলেন, এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সদিচ্ছার।

শেয়ার করুন