চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলম, তাঁর ভাতিজা সীতাকুণ্ড থেকে নির্বাচিত সাংসদ দিদারুল আলমসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতির মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
একই প্রতিবেদনে নগরের ডবলমুরিং থানার পরিদর্শক (বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে কর্মরত) হাসান আল মামুনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি মহানগর দায়রা জজ আদালতে প্রতিবেদনটি গ্রহণের ওপর শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
জানতে চাইলে মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলম ২১ জানুয়ারি দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ভাড়াটিয়া মীর ইফতেখারের সঙ্গে আপস হওয়ায় তিনি আদালতে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় দুদক চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, আপসের জন্য বাদীকে কোনো ধরনের ভয়ভীতি কিংবা চাপ দেওয়া হয়নি।
তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা অনুযায়ী ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলা মীমাংসাযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে দুদক চট্টগ্রামের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মাহমুদুল হক বলেন, মেয়র মন্জুর আলমসহ তাঁর ভাইপো ও ভাইদের বিরুদ্ধে তাঁদের এক ভাড়াটিয়া তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী দুর্নীতির মামলাটি করেন। এ ব্যাপারে ঊভয়পক্ষের মধ্যে আপস মীমাংসা হলেও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী মামলাটি আপসযোগ্য নয়। তবে আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি দুদকের প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্যতার ওপর শুনানি শেষে কী আদেশ দেওয়া হবে তা আদালতের এখতিয়ার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর মোস্তফা হাকিম রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ট্রেডিং করপোরেশনের মালিকানাধীন নগরের দেওয়ান হাট এলাকায় গোল্ডেন স্টার ভবনের প্রথম থেকে তৃতীয় তলা ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে মালিক পক্ষের সঙ্গে এস এ অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর ইফতেখার উদ্দিনের সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তির মেয়াদ ছিল ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
২০১১ সালে ভাড়াটিয়া মীর ইফতেখার উদ্দিন মেয়র ও তাঁর বড় ভাইসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা সহযোগে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন।
মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৫ সালের ৩১ আগস্ট ভারপ্রাপ্ত মেয়র থাকাকালে মেয়র মন্জুর আলম ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাদীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সারা দিন আটকে রাখেন। জোরপূর্বক ভাড়া বাবদ ১২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা আদায় করেন। আদালত মামলাটি তদন্তে দুদককে নির্দেশ দেন। তদন্ত চলাকালে বাদী গত বছরের ২৬ জুন মামলার বিষয়ে বিবাদীদের সঙ্গে আপস-মীমাংসা হয়েছে বলে দাবি করে আদালতে মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন জানান।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক যতন কুমার রায় ১৬ জানুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মামলার বাদী মীর ইফতেখার উদ্দিন ও আসামি মেয়র মন্জুর আলম, তাঁর ভাতিজা দিদারুল আলম, মেয়রের বড় ভাই আবু তাহের, তাঁর ছেলে শাহীন আলম, মেয়রের ছেলে সরোয়ার আলম, ফারুক আজম এবং মেয়রের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান মোস্তফা হাকিম হাউজিং রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ট্রেডিং করপোরেশনের কর্মকর্তা সোহেল আমিন, এস এম আসাদুজ্জামান ও জাফর আহমদের মধ্যে আপস মীমাংসা হয়। বাদী আদালত থেকে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। তিনি ও সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেবেন না বলে আদালতকে জানান। মামলাটি মীমাংসাযোগ্য না হলেও আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হবে না। তাই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আসামিদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি প্রদান এবং তদন্তে আগত হাসান আল মামুনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হলো।’
ফেঁসে গেলেন পুলিশ: দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনের কারণে ডবলমুরিং থানায় ২০০৭ সালে দায়িত্বরত এসআই (উপপরিদর্শক) হাসান আল মামুন ফেঁসে গেছেন। দুদক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নগরের ডবলমুরিং থানায় কর্মরত অবস্থায় ২০০৭ সালের ৭ জুন এসআই হাসান আল মামুন ভাড়া আদায়সংক্রান্ত একটি দেওয়ানি মামলাকে ফৌজদারি মামলা হিসেবে তদন্ত করেন। মোস্তফা হাকিম রিয়েল এস্টেটের নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম আসাদুজ্জামান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। পরে এসআই ভুয়া মোবাইল সিসি নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে মীর ইফতেখার ও তাঁর ভাই মীর ইকরামকে গ্রেপ্তার করে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। দুদিন পর ১৪ জুন আদালত থেকে তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে এসআই মামুনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি গ্রহণের সুপারিশ করেন দুদক কর্মকর্তা যতন কুমার রায়।
এ প্রসঙ্গে বর্তমানে জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত থাকায় হাসান আল মামুনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মামলার বাদী মীর ইফতেখারের বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও মুঠোফোনে তাঁকে পাওয়া যায়নি।