সময় যাচ্ছে, আর পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয় বাড়ছে। কিন্তু কাজ এগোয় না। মূল সেতু নির্মাণের কাজ শুরুর আগেই দ্বিতীয় দফা এক হাজার ২২১ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্প সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
২০০৭ সালে প্রথমে শুধু সড়ক সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছিল। কিন্তু এর সাড়ে তিন বছরের মাথায় নকশা পরিবর্তন করে সড়কের পাশাপাশি রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি অধিগ্রহণকৃত ভূমির মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। এতে খরচ বাড়ে আরও ১০ হাজার কোটি টাকা।
সাড়ে আট বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের ইতিমধ্যে সাড়ে ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো মূল সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। এমনকি প্রকল্প এলাকায় নদীশাসনের কাজও শুরু করা সম্ভব হয়নি।
বরং প্রকল্প এলাকায় ভয়াবহ নদীভাঙনের কারণে মাওয়া অংশে নদীশাসন এলাকার পরিধি বাড়াতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে আরও ৭০০ কোটি টাকা। আর প্রকল্প এলাকা থেকে বিদ্যমান বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ, ফেরি ও স্পিডবোট ঘাট সরানোর জন্য ৫২১ কোটি টাকা দরকার।
সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) পদ্মা সেতু প্রকল্পের ওপর একটি অবস্থানপত্র তৈরি করে। সেই অবস্থানপত্রে এ বাড়তি অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, এসব কাজ শেষ করতে আরও এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে। এ কারণে মূল সেতু নির্মাণের কাজ শুরু বিলম্বিত হতে পারে।
এ অবস্থানপত্রের আলোকে ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটির সভায় ব্যয় বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। মূলত বিদেশি সহায়তাপুষ্ট বড় প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নে এ কমিটি গঠন করা হয়। যদিও বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাইকা পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়িয়েছে।
বিলম্বের কারণে সময় ও ব্যয় বাড়লেও গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ১০ শতাংশ বা খরচ দুই হাজার ৫০ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে পদ্মা সেতুর জন্য পাঁচ হাজার ২৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও খরচ না হওয়ায় সংশোধিত এডিপিতে তা দেড় হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতিরিক্ত নদীশাসনের জন্য প্রকল্পে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। এমনকি নদীশাসনের কাজও সেতু বিভাগকে দেওয়া হয়নি।’ জরুরি ভিত্তিতে বাড়তি নদীশাসনের জন্য বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। তবে নদীশাসনের জন্য মূল সেতুর কাজ বিলম্ব হলেও আগামী জুনের মধ্যে দরপত্র-প্রক্রিয়া শেষ করার ব্যাপারে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব: আগামী জুন মাসে মূল সেতুর কাজ শুরু করার কথা থাকলেও নদীভাঙনের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। গত বছরের ভয়াবহ নদীভাঙনে মাওয়া প্রান্তে প্রস্তাবিত নদীশাসন এলাকাসহ পুরোনো বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ ও ফেরিঘাট এবং উজানে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে প্রকল্পের নদীশাসন এলাকায় বাড়তি ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার নতুন করে নদীশাসনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বলা হয়েছে। ফলে মাওয়া প্রান্তে প্রকল্প এলাকায় মোট ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হবে। কিন্তু পদ্মা সেতু বহুমুখী সেতু প্রকল্পে মাওয়া অংশে দেড় কিলোমিটার নদীশাসনের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। বাড়তি সোয়া কিলোমিটার নদীশাসনের জন্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
ইআরডির অবস্থানপত্রে বাড়তি নদীশাসনে অর্থ অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্পটি দ্রুত সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে প্রকল্পের মূল সেতু নির্মাণ এলাকার মাওয়া অংশে বর্তমানে বাসস্ট্যান্ড, ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট ঘাট রয়েছে। কিন্তু মূল সেতু নির্মাণকাজ শুরুর আগেই এ স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রকল্পে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। ইআরডির অবস্থানপত্রে বলা হয়েছে, মূল সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর আগেই দ্রুত জমি অধিগ্রহণ করে এসব স্থাপনা সরিয়ে নিতে প্রায় ৫২১ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। কিন্তু এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কোনো নিজস্ব তহবিল নেই। পুনরায় প্রকল্প সংশোধন করে সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
নৌ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত দল সম্প্রতি প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছে। এ কমিটি মাওয়ার পুরোনো ফেরিঘাটের উত্তরে কান্দিপাড়া এলাকায় ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডঘাট স্থানান্তরের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া সংযোগ সড়ক নির্মাণের সময় মাওয়া খানাবাড়ী থেকে প্রস্তাবিত লঞ্চ, ফেরি ও স্পিডবোট ঘাট পর্যন্ত বিকল্প পথে যান চলাচলের জন্য নতুন করে তিন কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করতে হবে। এ সড়ক নির্মাণের অর্থও মূল প্রকল্পে রাখা হয়নি।
নকশা পরিবর্তনে ব্যয় বেড়েছে: বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয় ধরে পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করে। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে সেতুর নকশা পরিবর্তন করে। নতুন করে ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। এখন আবার ব্যয় বাড়ছে।
সাড়ে ছয় বছরে বাস্তবায়ন ১০%: ২০০৭ সালের জুলাই মাসে কাগজে-কলমে এ প্রকল্পটি শুরু হয়। সাড়ে আট বছর মেয়াদের এ প্রকল্পের প্রথম সাড়ে ছয় বছরে অর্থাৎ গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মাত্র দুই হাজার ৫০ কোটি টাকা খরচ বা ১০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্পটি ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
এ প্রকল্পের মূল সেতু ও সড়ক এবং রেলপথের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। শুধু নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ, হুকুমদখল, ভূমি উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এ ছাড়া নদীশাসনের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মাওয়া সংযোগ সড়ক, টোল প্লাজা ও অন্যান্য সুবিধা নির্মাণের জন্য গত অক্টোবর মাসে ঠিকাদারকে ১৯৩ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ৩ শতাংশ।
একইভাবে জাজিরা সংযোগ সড়ক, টোল প্লাজা ও অন্যান্য সুবিধা নির্মাণকাজের বাস্তবায়ন মাত্র ১ শতাংশ। এ খাতে এক হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েনের কারণে ২০১২ সালের শেষ দিকে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। এসব দাতা সংস্থার ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি দেওয়ার কথা ছিল। সরকার এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে।