নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট সরকারের সাবেক তিন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমান ও তার আগের সংসদের চার এমপিসহ মোট সাতজনের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীর তুলনায় ২০১৩ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় তাদের সম্পদ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দুদক বিষয়টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল দুদকের পক্ষ থেকে সাত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপির সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য আলাদা কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
যে সাতজনের সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ও সাতক্ষীরা-৩ আসনের সংসদ সদস্য ডা. আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও পটুয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুবুর রহমান, ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য আসলামুল হক, কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি, রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য এনামুল হক ও সাতক্ষীরা সদরের সাবেক এমপি আবদুল জব্বার।
প্রসঙ্গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামা অনুযায়ী ৪৮ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সংগ্রহ করেছে দুদক। এদের মধ্যে থেকে গতকাল প্রথম পর্যায়ের সাতজনের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের পক্ষ থেকে পৃথক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ডা. আফম রুহুল হকের সম্পদ অনুসন্ধান করবে দুদকের উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম, অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খানের সম্পদ অনুসন্ধান করবে উপপরিচালক নাসির উদ্দীন, মাহাবুবুর রহমানের সম্পদ অনুসন্ধান করবে উপপরিচালক খায়রুল হুদা, আসলামুল হকের সম্পদ অনুসন্ধান করবে উপপরিচালক শেখ ফাইয়াজ, আবদুর রহমান বদির সম্পদ অনুসন্ধান করবে উপপরিচালক আহসান আলী, এনামুল হকের সম্পদ অনুসন্ধান করবে সৈয়দ তাহসিনুল আলম এবং আবদুল জব্বারের সম্পদ অনুসন্ধান করবে দুদকের সহকারী পরিচালক মাসুদুর রহমান।
সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামা অনুযায়ী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের স্ত্রী ইলা হকের সম্পদ ২০০৮ সাল থেকে এবার নির্বাচন পর্যন্ত ৭৮২ শতাংশ বেড়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিজের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১১০ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৮ সালে এর মূল্য ছিল ৩ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার ৬৮৪ টাকা। ২০১৩ সালে তা ৭ কোটি ৭৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৮৫ টাকা হয়েছে।
অন্যদিকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের ২০০৮ সালে হলফনামায় দাখিল করা সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী বার্ষিক আয় ছিল ২৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তখন তার নির্ভরশীলদের কোনো আয় না থাকলেও গত পাঁচ বছরে তিনি ও তার ওপর নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় সাড়ে তিন কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। গত পাঁচ বছর আগে তার সম্পদের মূল্য মাত্র সাড়ে ১০ লাখ টাকা হলেও বর্তমানে তা বেড়ে সাড়ে ১১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
এদিকে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান গত পাঁচ বছর আগে ২০ একর জমির মালিক থাকলেও বর্তমানে তিনি ২ হাজার ৮৬৫ একর জমির মালিক হয়েছেন। এসব জমির সিংহভাগ পর্যটন এলাকা কুয়াকাটা ও এর আশপাশে। বর্তমানে ওইসব জমির বাজার দর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০০৮ ও সাম্প্রতিক হলফনামা হিসেবে, গত পাঁচ বছরে ব্যাংকে জমা করা টাকা বেড়েছে ৫৮৬ দশমিক ৭৫ গুণ, জমি বেড়েছে ১৪৩ দশমিক ২৫ গুণ এবং বার্ষিক আয় বেড়েছে ৭৯ দশমিক ২৩ গুণ। তার স্ত্রী প্রীতি হায়দারের নামে স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ বেড়েছে ৩ দশমিক ২২ গুণ।
এছাড়াও সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি ২০০৮ সালের নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য স্ত্রী-ভাই-বোন ও নিজের কর্মচারীর কাছ থেকে আট লাখ টাকা ধার করেন। পরের পাঁচ বছরে তার আয় বেড়েছে ৩৫১ গুণ। তার বার্ষিক আয় এখন ৭ কোটি ৩৯ লাখ ৩৯ হাজার ৮০৮ টাকা। ব্যয় ২ কোটি ৮১ লাখ ২৯ হাজার ৯২৮ টাকা। ২০০৮ সালে তার বার্ষিক আয় ২ লাখ ১০ হাজার ৪৮০ টাকা ও ব্যয় ২ লাখ ১৮ হাজার ৭২৮ টাকা দেখানো হয়েছিল।
অন্যদিকে, ক্ষমতার পাঁচ বছরে ঢাকার সংসদ সদস্য মো. আসলামুল হকের ঘোষিত সম্পত্তি (জমি) বেড়েছে ৩৪ গুণের বেশি। ২০০৮ সালের হলফনামায় আসলামুল হক উল্লেখ করেন তিনি ও তার স্ত্রী মাকসুদা হক ৪ একর ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ জমির মালিক, দাম ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা। দশম সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় বলেছেন, স্বামী-স্ত্রী মিলে ১৪৫ দশমিক ৬৭ একর (১৪ হাজার ৫৬৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ) জমির মালিক, দাম ১ কোটি ৯২ লাখ ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া আসলামুল হকের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। গত পাঁচ বছরে আসলামুল হকের শুধু সম্পদই বাড়েনি, বেড়েছে শিক্ষাগত যোগ্যতাও। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ছিলেন অষ্টম শ্রেণি পাস। আর এখন তিনি বিবিএতে (স্নাতক ব্যবসায় প্রশাসন) অধ্যয়নরত বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।
সংসদ সদস্য এনামুল হক ২০০৮ সালে বেতন-ভাতা থেকে আয় করেন ২০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর পরে এখন কৃষি, বাড়ি ও দোকান ভাড়া, ব্যবসা ও পেশা থেকে বছরে তার আয় ৫০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর ২ কোটি ৮৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৮ কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা।