বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে বিদেশে নানা আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। নির্বাচনের পর নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ নিয়ে তাদের কার্যক্রমও শুরু করেছে। তো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে বিরোধীদলসহ বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান প্রহসন, তামাশা, একদলীয় নির্বাচন বলছে। তারা এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে। অন্যদিকে ভারতসহ কয়েকটি দেশ নতুন সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমরা কথা বলেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড.শওকত আরা হোসেনের সঙ্গে।
পুরো সাক্ষাতকারটি উপস্থাপন করা হলো
প্রশ্ন : গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশের বহুল আলোচিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে বহুবার বলেছিলেন তাদের অধীনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। কিন্তু বিরোধী দলের অভিযোগ ছিল বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এ কারণেই তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষে সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আজো আন্দোলন করছে।
তো নির্বাচনের পর এখন কোন্ পক্ষের বক্তব্যকে সঠিক মনে হচ্ছে?
ড.শওকত আরা হোসেন: বাংলাদেশে সম্প্রতি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় এসেছে। গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারাই ক্ষমতায় ছিল। তবে নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক সে সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য একরকম আর বিরোধী দলের বক্তব্য আরেক রকম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে যুক্তি দেখিয়েছে বিরোধী ১৮ দলীয় জোটও পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছে। তবে বিরোধী দল আর বিরোধী দলে নেই। কারণ তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। আমার মতে নির্বাচন হওয়ার দরকার ছিল। কারণ এটি একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তারপরও আমি বলব-নির্বাচনটা আরো কিছুদিন দেরিতে এবং সবদলের অংশগ্রহণে হলেও হতে পারত। সেক্ষেত্রে নির্বাচনটা সবদলের অংশগ্রহণে হয়নি। এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনার ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে বলেছিলেন তিনি সংবিধান থেকে একচুলও নড়বেন না। অন্যদিকে বিরোধী দল বলেছে তারা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে যাবে না। আর এভাবে সরকারী দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিএনপি যার যার অবস্থানে অনড় ছিল। তাদের এই অনড় অবস্থান থেকে সরিয়ে একটি সমঝোতার জন্য তখন জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো অনেক চেষ্টা করেছিলেন। বড় দুটি দল তার সেই আহবানে সাড়া দিয়ে বৈঠকে বসেছে আলোচনাও করেছে কিন্তু তাদের সেই আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। সেসময় নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।
প্রশ্ন : নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, এবারের নির্বাচনে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রায় ৫২ শতাংশ আসনে নির্বাচন হয়নি। তার মানে হচ্ছে, এই ৩৯ ভাগ ভোট পড়েছে দেশের ৪৮ ভাগ আসনে। এই পরিসংখ্যানটি সারাদেশের জন্য হিসাব করলে নির্বাচন কমিশনের দাবি অনুযায়ীই দেশের কত শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে?
ড.শওকত আরা হোসেন: নির্বাচন নিয়ে অন্যতম একটি বাস্তবতা হলো নির্বাচনের আগেই ১৫৩ টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। অবশিষ্ট ১৪৭ টি আসনে ভোট হয়েছে। এই আসনগুলোতে মোট ভোটার কত ছিল এবং কতজন প্রকৃত ভোট দিয়েছে সেটি এখানে বিবেচনার বিষয়। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে শতকরা ৪০.৬৬ ভাগ ভোট পড়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন যাই বলুক বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচনে ভোট খুব কম পড়েছে। তারপরও একটি নির্বাচন হয়েছে। এখানে অর্থমন্ত্রীর একটা বক্তব্য আমি কোড করতে চাই। তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, নতুন নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার প্রয়োজনে এক বছরের আগে একাদশ সংসদ নির্বাচন দেবেন বলে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন। তো সেই একাদশ নির্বাচনে বিরোধী দলকে আসতে হলেওতো একটা সমঝোতার প্রয়োজন। আর সেক্ষেত্রে এখন থেকেই বিরোধী দলকে আলাপ আলোচনা শুরু করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি বিরোধী দল তাদের কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রীসভা গঠনের মাধ্যমে কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছেন। অর্থাত দুপক্ষই ভীষণভাবে কর্মব্যস্ত। তবে তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে- দেশের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অথচ দেশের মানুষের সেই শান্তি কিভাবে আসবে সেকথা দুই নেত্রীর কেউ ভাবছেন না।
প্রশ্ন : আপনি যেমনটি বললেন, বাংলাদেশে গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন নানা কারণে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তো দশম জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার জের কাটিয়ে ওঠার মতো যথেষ্ট যুক্তি বা অনুকূল পরিস্থিতি কি নতুন সরকার সৃষ্টি করতে পারবে?
ড.শওকত আরা হোসেন: দেখুন আমাদের যারা বিদেশী বন্ধু যেমন আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন,কমনওয়েলথসহ অন্যন্যারা কিন্তু বাংলাদেশের এই নির্বাচনের বিরোধীতা করেছে। তাদের কাছে ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। তারা সংগত কারণেই হয়তো সেটা বলেছে। কারণ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ ছিল না। ভোটারের উপস্থিতি কম ছিল। তাছাড়া সহিংসতার কারণে তারা নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে না। গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে যে বিষয়টি আমাদেরকে বেশি করে মনে রাখতে হবে সেটি হচ্ছে- নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না থাকা। আর সবদলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হওয়ার পেছনে সরকার ও বিরোধী দলের একগুঁয়েমী কাজ করেছে। তারা স্ব স্ব অবস্থান থেকে এক চুলও নড়েনি। তবে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা দিয়েছে। ভারত চায় যে বাংলাদেশের শান্তি বজায় থাকুক। যে কারণে এ নির্বাচন ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
প্রশ্ন : নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখানোর কথা বলেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে খুব দ্রুত দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে বলেও বলা হচ্ছে। তো কি প্রক্রিয়ায় সেটি করা হতে পারে; যখন বিরোধীদলগুলো তাদের ভাষায় সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায়?
ড.শওকত আরা হোসেন: জ্বি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখানোর কথা বলেছেন। কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মানুষের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা আগে দেখা।সাধারণ মানুষের পীঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমাদের দেশের নিম্মবিত্তরা দিন আনে দিন খায়। তারা যদি দৈনন্দিন কাজ করতে না পারে তাহলে তাদের আহার জুটবে কি করে! তো সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে অভুক্ত রেখে বিরোধী দল তাদের আন্দোলন কতদিন চালাতে পারবেন? কাজেই আন্দোলনের ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসনেরও ভাবা উচিত। অবরোধ থাকলে তো যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকে। তাতে করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। ফলে বাস ট্রেন লঞ্চগুলো ঠিকমতো চলাচল করা দরকার। আন্দোলনে সহিংসতা হবে; তবে তার পাশাপাশি মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মও তো ঠিকঠাক থাকতে হবে। আমার মতে আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে কস্টের মধ্যে থাকে দিন মজুররা। যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের কিন্তু কোনো কিছুই হয়নি। যারা বিরোধী দলে ছিলেন তাদের বেশিরভাগ নেতা-নেত্রী জেলে গেছেন। আর পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে মারা গেছে সাধারণ মানুষ। গুলিতে, বোমার আঘাতে মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কাজেই সাধারণ মানুষের ভোগান্তির বিষয়টিকে মাথায় রেখে তবে আন্দোলন করতে হবে। আমি আরো বলবো- এ ধরনের আন্দোলন না করা উচিত। আর আওয়ামী লীগ যে জিরো টলারেন্সের কথা বলছে আমার মতে এসব পরের কথা আগে আলোচনায় বসা উচিত। আর সময়ক্ষেপণ না করে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত পরবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। আমাদের হাতে সময় কিন্তু অনেক নেই।আর বড় দুটি দলের মধ্যে আলাপ আলোচনার মধ্যে একটি বিষয় অবশ্য সমাধান করতে হবে। সেটি হচ্ছে- পাঁচ বছর পর যখন আবার নির্বাচন হবে তখন যেন এ ধরনের সহিংসতা না হয় এবং একটি সুষ্ঠু ও ভালো নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরী হয়।-রেডিও তেহরান।
প্রশ্ন : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এ সংক্রান্ত ছবি ও খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনায় কারা দায়ী? তাদেরকে গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে না কেনো?
ড.শওকত আরা হোসেন: দেখুন যখনই আমাদের দেশে একটা নির্বাচন হয় তখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আসল ভিকটিমাইজড হয় সংখ্যালঘুরা। কারণ একটি দল নির্বাচনে বিজয়ী হতে না পারলে বা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে তারা ভাবে যে ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং তারা আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। আর এদেশের সংখ্যালঘুদের নিশ্চয়ই ভারতের প্রতি বিশেষ কোনো আকর্ষণ আছে। যার ফলে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হবে। তাদের বাড়ি ঘর, দোকান লুট করতে হবে। এটা আমাদের এখানকার মানুষের একটা স্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব।
তবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমরা তাদেরকে নিরাপত্তা দেব একই সাথে তাদের ওপর যারা অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হবে। তবে এসবের জন্য সময় লাগবে। একই সাথে আমি বলব উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্রের সবকিছু কিন্তু দৃষ্টিগোচর হয় না। কারা সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে সেটা কিন্তু অনেক সময় বোঝা যায় না। কারণ তারা রাতের অন্ধকারে আসে এবং অন্ধকারেই পালিয়ে যায়। আর সেখানে কোনো সিসি ক্যামেরাও নেই যে সেই সব ঘটনার ছবি ধরে রাখা যাবে। এটি আমাদের একটি বড় দুর্বলতা।