(তিনি ছিলেন একজন মিশরীয় কপ্টিক খ্রিস্টান ধর্মযাজক। ইসলামের ‘খুঁত’ ধরার জন্য তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে ধর্মতত্ত্বে উচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। তবে ঘটে ঠিক উল্টো ঘটনা। আরব নিউজ পত্রিকায় A priest who found the truth in Islam শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে আরটিএনএন পাঠকদের জন্য লিখেছেন ফাতিমা ফেরদৌসী)
তিনি ছিলেন একজন মিশরীয় কপ্টিক খ্রিস্টান ধর্মযাজক। নাম ইব্রাহিম খলিল ফিলোবাস। ইসলামের ‘খুঁত’ অন্বেষণ করার জন্য তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে ধর্মতত্ত্বে উচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। তবে ঘটে ঠিক উল্টো ঘটনা। ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে গিয়ে তিনি এই ধর্মের প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়েন। ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি। তার নাম হয় আলহাজ ইব্রাহিম খলিল আহমদ। এরপর ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন তিনি।
শুধু ইব্রাহিম খলিল একা নন, তার পুরো পরিবারই এখন ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইসলাম গ্রহণকারী তার এক ছেলে প্যারিসের সরবন ইউনিভার্সিটির নামজাদা অধ্যাপক, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার।
তার মুখ থেকেই শুনুন ইসলাম গ্রহণে তার কন্টকাকীর্ণ দীর্ঘ যাত্রার বর্ণনা:
আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সকালে বিষয়টি নিয়ে আমি আমার স্ত্রীর সাথে আলাপ করলাম। তার ঘরে আমার তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে। তিনি যখন শুনতে পেলেন যে আমি ইসলাম গ্রহণ করতে আগ্রহী তখন হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
এরপর আমার স্ত্রী বিষয়টি গির্জার প্রধানকে জানান এবং তার সাহায্য চান। তার নাম মসিয়ার শাভিটস। দেশ সুইজারল্যান্ড। তিনি ছিলেন ধূর্ত প্রকৃতির লোক। তিনি আমার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি খোলাখুলি তাকে সব বলে দেই।
তিনি বললেন, ‘তোমার আসলে কী হয়েছে তা জানার আগ পর্যন্ত তোমাকে চাকুরিরচুত্য করে রাখা হবে।’ আমি তাকে বললাম, ‘এই নিন আমার পদত্যাগপত্র।’
তিনি আমাকে বুঝিয়ে আমার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা। তখন তিনি এই প্রচারণা চালাতে লাগলেন যে আমি পাগল হয়ে গেছি। এ অবস্থায় আমি কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়ে গেলাম। উপায়ান্তর না দেখে আমি আসওয়ান ছেড়ে কায়রো চলে এলাম।
কায়রোতে আমি একজন স্বনামধন্য অধ্যাপকের শরণাপন্ন হলাম। তিনি আমার বিস্তারিত কাহিনী না জেনেই এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করলেন। আমি তাকে বলেছিলাম আমি একজন মুসলমান। যদিও তখন পর্যন্ত আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করিনি। তিনি আমাকে মুসলমান বলেই বিশ্বাস করলেন।
ওই ব্যক্তির নাম ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনেম আল জামাল। তিনি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। ইসলাম সম্পর্কে তিনি খুবই আগ্রহী ছিলেন। তিনি আমেরিকায় কোরআনের অনুবাদ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি আমার সাহায্য চাইলেন। কারণ আমি অনর্গল ইংরেজি বলতে পারি। আমেরিকার ইউনির্ভাসিটি থেকেই আমি এমএ ডিগ্রি লাভ করেছি।
তিনি জানতেন যে আমি কোরআন, বাইবেল ও তোরা (ইহুদী ধর্মগ্রন্থ) সম্পর্কে তুলনামূলক অধ্যয়ন করছিলাম। এই তুলনামূলক অধ্যয়ণ এবং কোরআনের অনুবাদে আমরা একে অপরকে সাহায্য করতাম।
ড. জামাল যখন জানতে পারলেন, আমি আসওয়ান থেকে চাকুরি ছেড়ে চলে এসেছি এবং এখন বেকার তখন তিনি কায়রোর স্ট্যান্ডার্ড স্টেশনারি কোম্পানিতে আমাকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন।
এর কিছুদিন পরই আমি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়ে গেলাম। আমার স্ত্রী ধারণা করলেন, আমি সবকিছু ভুলে গেছি। তার ধারণা ছিল সংকটটা ছিল ক্ষণস্থায়ী এবং তা কেটে গেছে। কিন্তু আমি জানতাম যে ইসলাম গ্রহনের জন্য আমাকে জটিল পথ পাড়ি দিতে হবে। আমার ইচ্ছা ছিল তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শেষ হলে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলেই আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করবো।
১৯৫৫ সালে আমার তুলনামূলক অধ্যয়ণের কাজ শেষ হয় এবং আমি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হই। আমি ওই কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করে স্টেশনারি ও শিক্ষা সামগ্রী আমদানির একটি প্রশিক্ষণ কার্যালয় খুলে বসি। এটা ছিল একটি সফল ব্যবসা এবং আমার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আয় হতে থাকে। এরপর আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেই।
১৯৫৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর আমি কায়রোয় আমেরিকান মিশনের প্রধান ড. থম্পসনের কাছে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানিয়ে দেই যে, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমি যখন আমার সত্যিকার কাহিনী ড. জামালকে বললাম তিনি বিস্মিত হলেন।
১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারি আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পরই আমি নতুন জটিলতার মুখোমুখি হই। মিশনে আমার সাতজন সাবেক সহকর্মী আমার সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু আমি তাদের না করে দেই।
তারা বলেন, আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি বললাম, তিনি এখন মুক্ত। যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন। তারা আমাকে মেরে ফেলারও হুমকি দিলেন। কিন্তু তারা যখন দেখলেন আমি নাছোড়বান্দা তখন তারা আমার কাছে আমার এক পুরনো বন্ধু ও মিশনের সাবেক সহকর্মীকে পাঠিয়ে দেন। তিনি আমার সামনে অনেক কান্নাকাটি করেন।
তখন আমি তার সামনে কোরআনের এই আয়াত পাঠ করি:
‘আর রাসুলের (সা.) প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা যখন তা শুনে তখন আপনি তাদের চোখ অশ্রু সজল দেখতে পাবেন। এটা এ কারণে যে তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা বলে- হে আমাদের প্রতিপালক আমরা মুসলমান হয়ে গেলাম। অতএব আমাদের মান্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমাদের কি ওযর থাকতে পারে যে আমরা আল্লাহর প্রতি এবং যে সত্য আমাদের কাছে এসেছে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবো না এবং এ আশা করব না আমাদের প্রতিপালক আমাদের সৎ লোকের সাথে প্রবিষ্ট করাবেন?’ (সুরা আল মায়েদা; আয়াত: ৮৩-৮৪)
কিন্তু তিনি আমার সামনে অনেক কান্নাকাটি করেন। আমি তাকে বললাম, ‘তোমার উচিত কোরআন শুনার পর আল্লাহর ভয়ে কান্নাকাটি করা এবং সত্যকে বিশ্বাস করা, যেটা তুমি জান কিন্তু অস্বীকার কর।’ কোনো উপায় না দেখে এরপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং চলে গেলেন।
আমার স্ত্রী সে সময় আমাদের বাসার সব আসবাবপত্র নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু আমার সব সন্তানই আমার সাথে থেকে গেলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উৎসুক ছিলেন আমার বড় ছেলেন আইজাক। সে তার নাম পরিবর্তন করে রাখলেন ওসমান। আমার দ্বিতীয় ছেলে স্যামুয়েল ইসলাম গ্রহণ করে হন জামাল এবং আমার মেয়ে মাজিদার নাম হয় নাজওয়া।
এর মধ্যে ওসমান প্যারিসের সরবন ইউনির্ভাসিটির অরিয়েন্টোল স্টাডিজ এবং সাইকোলজির অধ্যাপক। তিনি লা মদে পত্রিকায় লিখে থাকেন। নাজওয়া বাণিজ্য বিষয়ে পড়াশুনা করছে। জোসেফ একজন ফার্মাকোলজিস্ট এবং জামাল ইঞ্জিনিয়ার।
আমর স্ত্রী চলে যাওয়ার পর আবার ১৯৬৬ সালে ফেরত আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তার দাবি ছিল সে খ্রিস্টান ধর্মেই থাকবেন। আমি তার আবদার মেনে নেই। কারণ ইসলামে কোনো জবরদস্তি নেই। আমি তাকে বলেছি- ‘আমার জন্য তোমার ইসলাম গ্রহণের প্রয়োজন নেই। ইসলাম সম্পর্কে সন্তুষ্ট হলেই শুধু একে কবুল করো।’
তিনি এখন নিজেকে মুসলামন বলে ভাবতে শুরু করেছেন। তবে তার পরিবারের ভয়ে তা এখনো ঘোষণা করছেন না। আমার সন্তানরা নামাজ পড়েন আর রমজানে রোজা রাখেন। তাদের সাথে আমার স্ত্রীও রোজা রাখেন।
১৯৬১ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত আমি ইসলাম এবং ইসলাম প্রচারের ওপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছি। এখন আমি ঐশী তিনটি ধর্মগ্রন্থের আলোকে ইসলামের নারীর মর্যাদা নিয়ে একটি বই লিখছি।
১৯৭৩ সালেই আমি হজ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে ইসলাম সম্পর্কে সভা সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছি আমি। আমার পুরো সময়ই কাটছে ইসলামের খেদমতে।
পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.) এর জীবনী অধ্যয়ন করেই ইসলামের ওপর আমার বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক ধারণাই আমার নেই। ইসলামের আল্লাহর একাত্ববাদের ধারণা প্রতি আমি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছি। আল্লাহ শুধুই এক। তার সমকক্ষ কেউ নেই। আমি নিজেকের শুধু আল্লাহর দাস ভাবি, অন্য কারো নয়।
এক আল্লাহর দাস ভাবলে মানুষ বহু লোকের দাসত্ব থেকে মুক্তি পায় এবং সেটাই হলো প্রকৃত স্বাধীনতা।