রাজধানীর পল্টনে পুলিশ ভবনে বিএনপি কর্মী ও কবিরাজ নান্নু মুন্সি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে পরকীয়া। পুলিশ কনস্টেবল শওকত হোসেনের স্ত্রী সঙ্গে কবিরাজ নান্নু মুন্সির গড়ে উঠা অবৈধ সম্পর্কের কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে গোয়েন্দারা। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া পুলিশ সদস্য শওকত জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরো দুইজনের কথা পুলিশের কাছে জানিয়েছেন শওকত।
হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২৭ ঘণ্টা পার হওয়ার পর বুধবার দিনব্যাপী অনেক চেষ্টার পর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশ নান্নুর মণ্ডুটি উদ্ধার করে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের একটি পুকুর থেকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (পূর্ব) সহাকারী কমিশনার জুয়েল রানার নেতৃত্বে একটি টিম গ্রেপ্তারকৃত পুলিশ সদস্য শওকতের দেয়া তথ্য অনুযায়ী মণ্ডটি উদ্ধার করে।
এর আগে মঙ্গলবার সকালে পল্টন থানার পেছনে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স সংলগ্ন পুলিশ ভবনের ছাদ থেকে মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করে পল্টন থানা পুলিশ। তখন নিহত ব্যক্তিকে পুলিশের কোনো সদস্য বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর একদিন পরই বুধবার সকালে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের সূত্র ধরে বুধবার নান্নুর লাশ সনাক্ত করে তার পরিবারের সদস্যরা। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নান্নু মুন্সি কবিরাজী করতো।
নিহত নান্নু মুন্সির মেয়ে টুম্পার বরাত দিয়ে আত্মীয় সাবিরা নাজমুল বাংলামেইলকে জানান, মঙ্গলবার টিভিতে জামা-কাপড় এবং লাশের সুরতহাল দেখে নান্নুর মেয়ে সাবিরাকে জানায় ওটা তার বাবার লাশ। নান্নু ট্রাফিক ভবনের এক পুলিশের কাছে টাকা পেতো। টাকা দেয়ার নাম করে তিনি নান্নুকে ওই পুলিশ ভবনে ডেকে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে তার বাবার মোবাইল বন্ধ ছিল।
নান্নু মুন্সির স্ত্রীর ভাই জয়নাল আবেদিন বাংলামেইলকে জানান, নান্নু মুন্সি কবিরাজী জানতো। পুলিশের গাড়ি চালক শওকতের স্ত্রীর চিকিৎসা করতে তিনি প্রায়ই যশোর থেকে ঢাকা আসতেন।
জানা গেছে, ১৯ জানয়ারি নান্নু ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে আসার পাশাপাশি পুলিশ সদস্য শওকতের কাছে ওষুধ নিয়ে যায়। সেখানেই তিনি খুন হন। তাকে প্রথমে শ্বাসরোধে হত্যার পর বুকে একাধিক আঘাত করা হয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে। একপর্যায়ে দেহ থেকে মণ্ডু আলাদা করে তা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুকুরে ফেলে দেয়া হয়। পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিত্বে পুলিশ বুধবার সকালে শওকতকে গ্রেপ্তার করে। পরে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করে শওকত।
এ প্রসঙ্গে ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম জানান, নিরাপত্তার মধ্যে পুলিশ ভবনে এ রকম একটি নৃশংস হত্যকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশকে ভাবিয়ে তোলে। প্রথম থেকে তাদের সন্দেহ ছিল এ হত্যাকাণ্ডর সঙ্গে পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত থাকতে পারে। সে সন্দেহের দিক থেকে তারা হত্যার ক্লু উদঘানে এবং জড়িত খুনীদের সনাক্ত করতে তদন্তে নামে। তদন্তের এক পর্যায়ে বুধবার সকালে নিহত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ সদস্য শওকতকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শওকত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল জানান, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আরো দুইজন ছিল বলেও পুলিশকে জানায় শওকত। ওই দুইজন ভাড়াটে খুণি ছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে গোয়েন্দারা মনে করছে বাইরের কোনো লোক নয় দুইজনও ওই ভবনে থাকা পুলিশ সদস্য।
মনিরুল ইসলাম জানান, শওকত পুলিশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) বিভাগে কর্মরত ছিল। সম্প্রতি স্ত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে বরখাস্ত করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আনা হয়। এরপর থেকে তিনি ওই ভবনে থাকতেন। ওই ভবনে ট্রাফিক, এসবি, সিআইডিসহ পুলিশের অনেক সদস্যই থাকেন।
তিনি জানান, নিরপত্তা জোরদার থাকার কথা থাকলেও ওই ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। আর এ সুযোগে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার পর ওই ভবনসহ পুলিশ ব্যারাকের অন্যান্য ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন রয়েছে তা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার মীর রেজাউল আলমকে প্রধান করে মতিঝিল ডিবিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আশরাফুজ্জামান ও গোয়েন্দা পুলিশের একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনারকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। গঠিত কমিটির দেয়া তদন্ত রিপোর্টের পর পুলিশ ব্যারাকে এ ধরনের ঘটনা যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।
এদিকে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্য শওকতের স্ত্রীর সঙ্গে কবিরাজ নান্নু মুন্সির অবৈধ সম্পর্ক বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কারণ শওকতের যৌন দুর্বলতা ছিল। যৌন দুর্বলতা কাটাতে শওকত নান্নু মুন্সির কাছ থেকে কবিরাজী ওষুধ খেতো। পাশাপাশি তার স্ত্রীরও সমস্যা ছিল। আর এ কারণে নান্নু মুন্সি শওকতের স্ত্রীরও চিকিৎসা করতো। চিকিৎসা সেবার সুযোগে শওকতের স্ত্রীর সঙ্গে নান্নু মুন্সির অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে বিষয়টি টের পেয়ে যায় শওকত। এ ঘটনায় নান্নুকে মারার পরিকল্পনা করে ওই পুলিশ সদস্য। পরিকল্পনা মতে নান্নুকে ওষুধ নিয়ে ঢাকায় আসতে বলে শওকত।
শওকতের সঙ্গে কথা হওয়ার পর ২০ জানুযারি বিএনপির সমাবেশে নিতে ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় আসে নান্নু। ২০ জানুয়ারি সমাবেশ শেষে নান্নু কবিরাজ শওকতের কাছে যায়। ওই রাতেই তাকে হত্যা করা হয়।
সূত্র জানায়, পুলিশ কনস্টেবল শওকতের বাড়ি ঝিনাইদহে। নান্নুর বাড়ি যশোরের ঝিকারগাছায়। নান্নুর সঙ্গে শওকতের কীভাবে কতদিনের পরিচয় সব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মতিঝিল জোনের সহাকারী পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুর রহমান বাংলামেইলকে জানান, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বরখান্ত হওয়া পুলিশ সদস্য শওকতকে। এতে আরো অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। শওকতের দেয়া তথ্য মতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরো দু’জন জড়িত ছিল ওই দুজনের নাম এবং হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জানার জন্য শওকতকে রিমান্ডে আনা হবে। একই সঙ্গে কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে সে বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে।