নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী হামলা মামলায় জর্জরিত যশোরে বিএনপি সমর্থিত ১৮ দলের নেতাকর্মীরা।
বিএনপি জামাতসহ জোটভুক্ত শরিক দলের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশ পুলিশী আতঙ্কে ঘর ছাড়া। ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় আড়াই হাজার নেতাকর্মী কারাগারে আটক।
গাড়ি পোড়ানো, সড়ক অবরোধ, যানবাহন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর, পুলিশী কাজে বাধা, বিজিবির গাড়ীতে হামলা, বিআরটিসির বাসে অগ্নিসংযোগ, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, নির্বাচন বানচালের চেষ্টা, ভোট কেন্দ্রে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, ভোট কেন্দ্রে বোমা হামলা, অস্ত্র প্রদর্শণ, ভোটের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের উপর হামলা, মারপিট, স্কুলে অগ্নিসংযোগ, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, নির্যাতন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, সংখ্যালঘু নারীদের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানান অভিযোগে যশোরের বিভিন্ন থানায় গত ৬ মাসে বিএনপি জামাত ও সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নামে ৫৮২টি মামলা রেকর্ড করেছে পুলিশ।
এর অধিকাংশই রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছে বলে দাবি বিএনপি জামাতের নেতাকর্মীদের। এসব মামলায় আসামী করা হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার নেতাকর্মীকে।
কোর্ট পুলিশ সূত্রে জানা গেছে এসব মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মনিরামপুর থানায়। এই থানায় গত ৬ মাসে মোট ২৩৭টি মামলা রেকর্ড করেছে পুলিশ । এর মধ্যে গত ৫ তারিখের নির্বাচনের দিনই মামলা হয়েছে ৬১টি। এসব মামলায় ৩৫ হাজারের বেশি মানুষকে আসামী করা হয়েছে। এই থানায় আরো ১০ হাজারের বেশি মানুষ বিভিন্ন মামলার আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
ইতোমধ্যে পুলিশ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দায়েরকৃত মামলায় বিএনপি জামাতের প্রায় দুই হাজার কর্মী সমর্থককে আটক করে জেল হাজতে পাঠিয়েছে। এদের অনেকেই ইতোমধ্যে জামিনে বের হয়েছে। কিন্তু ফের পুলিশী গ্রেফতার এড়াতে তারাও ঘর ছাড়া।
প্রাপ্ত সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ মাসে সরকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম চলাকালে যশোর কোতয়ালী মডেল থানায় ৬৫টি, মনিরামপুর থানায় ২৩৭টি, কেশবপুর থানায় ৩২টি, অভয়নগর থানায় ৩৯টি, বাঘারপাড়া থানায় ৩৫টি, চৌগাছায় ৪১টি, ঝিকরগাছায় ৪৮টি, শার্শায় ৪৭টি ও বেনাপোল পোর্ট থানায় ৩৮টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে।
দায়েরকৃত এসব মামলার অধিকাংশের বাদী পুলিশ বা সরকারি দলের নেতাকর্মীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আন্দোলন সংগ্রাম চলাকালে যশোরের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক নাশকতা সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জান-মালের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায় ১৮ দলের নেতাকর্মীরা। এসময় তাদের হামলা থেকে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ পথচারী, পুলিশ, বিজিবি ও র্যা ব কর্মকর্তারাও রেহায় পাননি।
দিনের পর দিন তারা সড়ক অবরোধের নামে যশোর-বেনাপোল, যশোর-কেশবপুর, যশোর-খুলনা, যশোর-মাগুরা সড়কসহ জেলার আভ্যান্তরিণ রুটের প্রায় সবগুলো সড়ক অবরোধ করে ব্যাপক অরাজকতা সৃষ্টি করে। রাস্তার গাছ কেটে সড়ক অবরোধের পাশাপাশি বিভিন্ন রাস্তার পাশের সরকারি গাছ লুটপাটেরও অভিযোগ রয়েছে ১৮ দল- বিশেষ করে জামাত শিবিরের নেতাকর্মীদের নামে।
এছাড়া যশোরের নতুনহাট, চাঁচড়া মোড়, মুড়লী মোড়, খাজুরা বাসস্ট্যান্ড, খাজুরা সড়কের ভাটার আমতলা, কেশবপুর সড়কের ব্যাগারীতলা, চালকীডাঙ্গা, সুতিঘাটা, গোপালপুর, রাজগঞ্জ সড়কের জামতলা, পুলেরহাট, খুলনা সড়কের রূপদিয়া, জঙ্গলবাঁধাল, দলমঘাটা মোড়, বসুন্দিয়া, চেঙ্গুটিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধের নামে গত ৬ মাসে প্রায় পাঁচশোরও বেশি যানবাহন ভাংচুর ও তাতে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোলবোমা হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে হতাহত করে জামাত শিবির ও বিএনপির কর্মী সমর্থকরা।
রেহায় পায়নি পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের টহল দল। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে যশোরের রূপদিয়া বাজারে র্যা বের গাড়ি বহরে হামলা চালায় অবরোধকারীরা। এই হামলায় র্যা বের একজন সদস্য গুরুতর আহত হয়। এর দুদিন আগে একই স্থানে অবরোধকারীদের আক্রমণের শিকার হয় বিজিবির একটি টহল দল।
এসব ঘটনায় পৃথক পৃথক মামলা করে হামলার শিকার আইনশৃঙ্কলা বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়া যশোরের নতুন হাটে একটি সার বোঝাই ট্রাকে পেট্রোল বোমা হামলা চালালে ট্রাকের চালক ও হেলপার গুরুতর আহত হয়। কেশবপুরে ও মনিরামপুরে দুইটি ট্রাকে অগ্নিসংযোগ করে অবরোধকারীরা। রূপদিয়া রংপুরগামী বিআরটিসির একটি বাস পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত এএসপি রেশমা শারমিন বলেন, এর সঙ্গে পুলিশের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। তবে প্রধানমন্ত্রীর যশোর আগমনকে কেন্দ্র করে জেলা পুলিশের সব কর্মকর্তা এখন ভীষণ ব্যস্ত। ফলে এই মুহুর্তে এসব বিষয়ে সদুত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।
গত ৬ মাসে যশোরের বিভিন্ন থানায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা করে আটক করা হয়েছে, তারমধ্যে যশোর জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ও পৌর কাউন্সিলর হাজী মুকুল, জেলা জামাতের সেক্রেটারি মাস্টার নুরুন্নবী, যশোর শহর জামাতের আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল, সদর উপজেলা জামাতের সেক্রেটারি অধ্যাপক আবুল হাসিম রেজা, প্রচার সম্পাদক অধ্যাপক মেস্তফা হোসেন উজ্জল, যশোর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি রবিউল ইসলাম, সেক্রেটারি সুমন, চৌগাছা জামাতের সেক্রেটারি মাওলানা গোলাম মোর্শেদ, সহ সেক্রেটারি তুহিনুজ্জামান, মনিরামপুর বিএনপির সভাপতি ও পৌর মেয়র এ্যাড. শহীদ মোহাম্মদ ইকবাল, যুবদলের সভাপতি ও মনিরামপুর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নিস্তার ফারুক, খেদাপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক,কাশিমনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাত নেতা মিজানুর রহমান, ঝিকরগাছা পৌর যুবদলের সভাপতি নজরুল ইসলাম, উপজেলা জামাতের আমির মাওলানা আরশাদুল আলম, বাঁকড়া ইউনিয়ন জামাতের রোকন সিরাজুল ইসলাম, ঢাকুরিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ইসরাইল হোসেন, দূর্বাডাঙ্গা ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল আলীম,শার্শার বিএনপি নেতা কেরামত হোসেনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
এদিকে হামলা মামলার শিকার হয়ে জেলা বিএনপির প্রথম সারির সব নেতাই এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। বিএনপি নেত্রী অধ্যাপক নার্গিস বেগম ও মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী বেগমের নেতৃত্বে জেলা বিএনপির তৃতীয় স্তরের নেতারা এখন যশোরের রাজপথ দখলে রেখে বিরোধী দলের সব রকমের আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এর পাশাপাশি নগর বিএনপির সভাপতি পৌর মেয়র মারুফুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক মনির আহম্মেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, জেলা বিএনপির তরুন নেতা অনিন্দ্য ইসলাম অমিত যুব সমাজকে সংগঠিত করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বার বার হামলা মামলার শিকার হয়েছেন। এসব নেতাদের প্রত্যেকের নামে একাধিক মামলা রয়েছে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন, চেম্বার সভাপতি আলহাজ্ব মিজানুর রহমান খান, সহ সভাপতি গোলাম রেজা দুলু, যুবদল সভাতি এহসানুল হক মুন্না, বিএনপি নেতা ইসহাক হারুন, আমিনুর রহমান মধু, আসাদুজ্জামান শাহীনসহ জেলা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কয়েকশ’ নেতাকর্মী সরকার বিরোধী আন্দোলনে হামলা মামলার শিকার হয়ে এখন পলাতক জীবন যাপন করছেন।
দলের কেন্দ্রীয় নেতা তরিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন। ফলে রাজনৈতিক ডামাডোলে যশোর জেলা বিএনপি ও ১৮ দলের অভ্যান্তরে চরম ভাবে নের্তৃত্বের শুন্যতা বিরাজ করছে।
এদিকে অভয়নগরের চাপাতলার মালোপাড়া আর মনিরামপুরের হাজরাঈলের ঋষীপাড়ায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১৫ দিনে এই দুই উপজেলার কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষকে ঘরছাড়া করেছে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। খোদ পুলিশ সুপার জয়দেব ভদ্র স্বীকার করেছেন চাপাতলার মালোপাড়ায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংস ঘটনায় পুলিশ বাদী মামলায় ৩৯ জন এজাহার নামীয় আসামীর পাশাপাশি অজ্ঞাত দুই থেকে আড়াইশ জনকে আসামী করা হয়েছে। পুলিশ এ পর্যন্ত ওই মামলার এজাহার ভুক্ত মাত্র দুই জন আসামীকে আটক করেছে। অপরদিকে সন্দেহজনক হিসেবে আটক করেছে আরো ৫৪ জনকে।
এদের মধ্যে বাহাদুর নামে একজন চা বিক্রেতাও রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে নওয়াপাড়া বাজারের নূরবাগের শাহীন টি স্টলের মালিক বাহাদুর। ১০/১২ বছর ধরে একটি টঙ ঘরে বাহাদুর চা বিক্রি করে তার সংসার চালায়। এই দোকানের আয়ে বাহাদুরের ৩টি ছেলে মেয়ে স্কুলে পড়ে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত মালোপড়ায় হামলার তিন দিন পর রাত ১১টার দিকে অভয়নগর থানার পুলিশ অফিসার শাহীন নওয়াপাড়া রেল স্টেশন এলাকার একটি বস্তির ভাড়া বাসা থেকে বাহাদুরকে আটক করে।
প্রথমে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন ওই দারোগা। কিন্তু বাহাদুরের পক্ষে সে টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত দারোগা শাহীন বাহাদুরকে চাপাতরার মালোপাড়ার সহিংস ঘটনার আসামী করে জেল হাজতে পাঠিয়েছে। পিতার অবর্তমানে তার চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে আরিফ হাওলাদার এখন স্কুল ছেড়ে চায়ের দোকানদারী করছেন। এই চা দোকান থেকে যা আয় হচ্ছে তাই দিয়ে চলছে তাদের সংসার। এভাবে চাপাতলার মালোপড়া আর হাজরাঈলের ঋষীপাড়ার সংখ্যলঘুদের উপর ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের বিরুদ্ধেও উঠেছে অর্থবাণিজ্যের অভিযোগ ।