কূটনীতি নির্ভর নয়, বিএনপিকে জনগণ নির্ভর রাজনীতি করতে হবে

0
96
Print Friendly, PDF & Email

যখন বেগম খালেদা জিয়া অনেকটা নজরবন্দি ছিলেন এবং যখন তার সাথে কারো দেখা-সাক্ষাৎ করাও প্রায় অসম্ভব ছিল, যখন তার গুলশানের বাসায় আগমন এবং নির্গমনকারীর ভাগ্যে লেখা থাকত কারা ফটক, তখনও বিদেশী দূতরা তার সাথে দেখা করেছেন। ৫ জানুয়ারী ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরেও কূটনীতিকরা তার সাথেই দেখা-সাক্ষাৎ করছেন। এখন সরকার রেসট্রিকশন কিছুটা শিথিল করেছেন। তবুও বিদেশী কূটনীতিকরা তার সাথেই ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা করছেন। তারাই বলছেন যে, বাংলাদেশ গভীর সংকটে নিপতিত। সংকটের বাস্তব সমাধানের জন্য তাদের কাছে কোন ফর্মূলা আছে বলে বোঝা যায় না। আমি বুঝতে পারি না, ওরা বার বার বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেন কেন? ওদের সকলেরই বোঝার কথা যে, বর্তমান সংকটের সমাধানের চাবি কাঠি শেখ হাসিনার হাতেই রয়েছে। সুতরাং বিদেশী কূটনীতিকরা সত্যিই সত্যিই যদি কোন সমাধান চান তাহলে বিরোধীদলীয় নেতার সাথে এত ঘন ঘন দেখা না করে সরকারের দুয়ারে করাঘাত করুন। তাহলেই তাদের পালস বোঝা যাবে।
তবে বলতেই হবে যে, এবারের কূটনৈতিক উদ্যোগটি গতবারের মত অর্থাৎ ২০০১ বা ২০০৬ সালের মত হয়নি। ২০০১ সালের গোড়ার দিকে বেগম জিয়া ছিলেন বিরোধী দলে। আর ২০০৬ সালের অক্টোবরের আগে তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০০৬ সালের অক্টোবরের পর কেয়ারটেকার সরকারের হাতে সংবিধান মোতাবেক তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই উভয় সময়েই দেখেছি, কূটনীতিকরা বেগম জিয়ার কাছেই ছুটাছুটি বেশি করেছেন এবং বিরোধী দলের দাবী তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে বেগম জিয়ার কাছে অষ্টপ্রহর মিটিং করেছেন। তখন তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল ক্ষেত্র সৃষ্টির জন্য বেগম জিয়ার ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে ছিলেন। সমতল ক্ষেত্রের অর্থ হলো নির্বাচনে যেন সমস্ত দল সমান সুযোগ-সুবিধা পায়। এছাড়াও নির্বাচনে যেন সমস্ত দল অংশগ্রহণ করতে পারে তার জন্য বেগম জিয়াকে চাপের মধ্যে রাখা হয়েছিল।
এবার তাদের ভিন্ন
ভূমিকা কেন?
তারা সেই সময় যে ভূমিকা নিয়ে ছিলেন, সেদিন সেগুলো নিয়ে কিন্তু কোন প্রশ্ন ওঠেনি। সেদিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিস বিউটেনিস এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর দৌড়া-দৌড়ি ছিল দেখার মত। আর ভারতীয় হাইকমিশনারের ভূমিকা ছিল নেপথ্য থেকে কলকাটি নাড়ার। তারপরেও মানুষ, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এগুলোর বিরোধিতা করেননি। কেউ সেদিন প্রশ্ন করেননি যে, বিদেশীদের এত ছুটাছুটি করাটা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল হচ্ছে। অথচ আজ চিত্র মোটামুটি বিপরীত। বিদেশীরা যখন বলেছে যে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি করতে হবে, যখন বলেছে সব দলকে নির্বাচনে আনতে হবে তখন সেই চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীরাই বলছেন যে, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সাবেক সেনাপ্রধান এবং আওয়ামী লীগ নেতা জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ এই তো দু’তিন দিন আগে দাবি করেছেন যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনাকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হোক। সরকারপন্থী মুখচেনা রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বুদ্ধিজীবীরা প্রশ্ন করছেন যে, ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বৃটেন-আমেরিকা নাক গলাতে সাহস পায় না। তারা আরো প্রশ্ন করেন যে, আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কি বাংলাদেশী কূটনীতিক নাক গলাতে পারবেন? অর্থাৎ তাদের মত বিশ্লেষণ করলে পরোক্ষভাবে এই দাঁড়ায় যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তত্ত্বাবধায়ক দাবি সম্পর্কে বিদেশীদের ভূমিকা হয় এক রকম, আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে তাদের ভূমিকা হয় আরেক রকম।
বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে
বিদেশীদের নতুন ভূমিকা
এই বিদেশীরাই ৫ জানুয়ারীর ভোটারবিহীন নির্বাচনের পূর্বে এক রকম ভূমিকা রেখেছিল। আর ৫ জানুয়ারীর পর তাদের ভূমিকা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ। তখন তারা বলেছে যে, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া যদি এই নির্বাচন হয় তাহলে সেই নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু বাস্তবে আওয়ামী ঘরণা ছাড়া অবশিষ্ট ৩০/৪০টি রাজনৈতিক দল ছাড়াই নির্বাচন হয়ে গেল। কৈ, এখন তো তারা উচ্চ কণ্ঠে বলছে না যে, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা তো বলছে না যে নতুন নির্বাচন হওয়া দরকার। যেটুকু বলছে সেটুকু বলছে মিন মিন করে। অথচ বেগম জিয়ার সাথে তারা বার বার ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ করছেন। এখন তারা মূল দাবি থেকে সরে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দাবি তুলেছেন। বলছেন যে, সংলাপ হতে হবে, তবে তার পূর্বে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে। আরো বলছেন যে, জামায়াত এবং হেফাজতে ইসলামের সাথে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সন্ত্রাসী সংগঠনসমূহের সাথে কোন সম্পর্ক আছে কি না সেটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন খতিয়ে দেখছে।
এখানে সংগতভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, জামায়াতের সাথে বিএনপি সম্পর্ক ত্যাগ করবে কিনা সেটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ই নয়, এটি রীতিমত জামায়াত ও বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও নগ্ন হস্তক্ষেপের শামিল। জামায়াতের সংগ ছাড়লে বিএনপির লাভ হবে না ক্ষতি হবে সেটি ভাল বুঝবে বিএনপি। কিন্তু তারা যে দাবিটি করেছে সেটি তো এখন আওয়ামী লীগের দাবির প্রতিধ্বনি হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্ত্রী এবং প্রচার সম্পাদক হাসান মাহমুদ পর্যন্ত বলছেন যে, বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ে তাহলে আলোচনা হবে। আর সঙ্গ না ছাড়লে কোন আলোচনা নয়। পশ্চিমারা জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার যে দাবি তুলেছেন সেটি বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল কিনা, সেই বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে এখন তারা বলছেন যে, পশ্চিমারা বিশেষ করে আমেরিকাও চায় যে, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়া হোক।
কোথায় গেল তত্ত্বাবধায়ক?
কোথায় গেল নতুন নির্বাচন?
বিদেশীরা, বিশেষ করে পশ্চিমারা, নাকি গণতন্ত্রের পূজারী। তারা নাকি গণতন্ত্রের প্রশ্নে কোন আপোষ করে না। কিন্তু এখন তারা যা করছেন সেটি তো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লংঘনের সাথে গলাগলি করার শামিল। ৩শ’ সদস্যের মধ্যে ১শ’ ৫৩ জনের নির্বাচনের, যেখানে প্রায় ৫ কোটি ভোটারের ভোট দেয়ার প্রয়োজন হলো না, সেখানে সেই সরকারের কোন বৈধ এবং গণতান্ত্রিক ভিত্তি থাকে কি? এ ব্যাপারে বিদেশীরা সোচ্চার নয়। বিদেশীরা আমাদের ব্যাপারে সোচ্চার হোক, সেটি আমরা চাই না। কিন্তু ওরা একচোখে তেল বেচবে, আর আরেক চোখে নুন, এমন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মোটেই কাম্য নয়।
বিএনপির করণীয়
এই পটভূমিতে বিএনপির যেটি করণীয় সেটি হলো কূটনীতি নির্ভর রাজনীতি নয়, বরং জনগণ নির্ভর রাজনীতি। কূটনীতিকরা ক্ষমতাকে নৈবদ্য হিসাবে প্লেটে সাজিয়ে বিএনপিকে উপহার দেবে না। জনগণকে সাথে নিয়ে প্রচ- গণআন্দোলনের মাধ্যমে শুধু বিএনপি নয়, বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট যদি ক্ষমতার ভিত্তি নাড়িয়ে দিতে পারে তাহলে বিএনপির দাবি যেমন আদায় হবে, তেমনি বিদেশীরাও তখন বিএনপির বক্তব্য বা অবস্থানকে মূল্য দেবে। আর জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হলে শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়কের মধ্যেই আন্দোলন সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, জনগণের দৈনন্দিন সমস্যাবলী, যেগুলো তাদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে, সেগুলো নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

শেয়ার করুন