মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের খালাস পাওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তারেক রহমানকে বিচারিক আদালত ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রোববার বিচারপতি নিজামুল হক এবং বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। আপিল আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।
গত ১৭ নভেম্বর তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দিয়ে তার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে অর্থপাচার (মানিলন্ডারিং) মামলায় ৭ বছরের কারাদ- দেয় ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালত। রায়ে কারাদ-ের পাশাপাশি মামুনকে ৪০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। পাচারকৃত ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৬১৩ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করারও নির্দেশ দেয় আদালত।
এ রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর আপিল করে দুদক। গত বৃহস্পতিবার এ আপিলের শুনানি গ্রহণ প্রশ্নে শুনানি শুরু হয়।
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০২-এর ২(ঠ), (অ), (আ) এবং ১৩ ধারায় ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. মোতাহার হোসেন দুদকের করা মামলায় এ রায় দেন। মামলা করা থেকে রায় পর্যন্ত পুরো বিচার প্রক্রিয়ায়ই তারেক রহমান অনুপস্থিত ছিলেন।
খালাসপ্রাপ্ত তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। মামুনকে সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
রায়ে বিচারক বলেন, যদিও মামলার প্রধান সাক্ষী নির্মাণ কন্সট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাদিজা ইসলাম মামুনকে দেয়া টাকা কনসালটেন্সি ফি হিসেবে দিয়েছেন মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামুনও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে ওই টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু ওই পরিমাণ টাকা ফি হিসেবে নেয়ার মতো কনসালটেন্সি ফার্ম মামুনের ছিল না। ওই টাকা অনৈতিকভাবে চাপ দিয়ে নেয়া হয়েছিল মর্মে প্রমাণিত হয়েছে।
ওই টাকা দেশে গ্রহণ করলে বিভিন্ন ঝামেলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় বিদেশে গ্রহণ করা হয়, যা মানিলন্ডারিং আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তারেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মামুনের অ্যাকাউন্ট থেকে ভিসা কার্ডের মাধ্যমে ৫০ হাজার ডলার উত্তোলন করে খরচ করেছেন। ওই টাকা খরচ করার কথা তারেক রহমান অস্বীকার করেননি। ২০০৭ সালে তারেক রহমান দুদকে দাখিল করা হিসাব বিবরণীতে তা উল্লেখ করেছেন বিধায় তারেকের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেয়া হয়েছিল।
গত বছরের ২৬ মে তৎকালীন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ মো. মোজাম্মেল হোসেন ইন্টারপোলের মাধ্যমে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন।
এ মামলায় তারেক রহমান পলাতক থাকায় তার পক্ষে কোনো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়নি। ৮ নভেম্বর দুদকের আইনজীবী এবং ১৪ নভেম্বর মামুনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তার আইনজীবীরা।
২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মামলাটিতে মোট ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। তারা হলেন_ দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক ও মামলার বাদী মোহাম্মদ ইব্রাহিম, মামলাটির রেকর্ডিং অফিসার হোসনে আরা বেগম, ধোবাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আলীমুজ্জামান, গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল উদ্দিন, নির্মাণ কন্সট্রাকশন কোম্পানির চেয়ারপারসন খাদিজা ইসলাম, পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদ করিম, সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার সৈয়দ এহসানুল হাফিজ, সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. নজরুল ইসলাম, নির্বাহী কর্মকর্তা বিভূতি ভূষণ সরকার, ব্যাংকটির জেনারেল ম্যানেজার ওমর ফারুক ভূঞা, দুদকের উপ-পরিচালক সৈয়দ তাহসিনুল হক এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
চার্জশিট বহির্ভূত সাক্ষী হিসেবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) এজেন্ট ডেবরা লেপরোভেট এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর মামুনের পক্ষে ৫ জন সাক্ষী সাফাই সাক্ষ্য প্রদান করেন। তারা হলেন_ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ওয়ান গ্রুপের কর উপদেষ্টা আহমেদ আজম খান, ওয়ান কম্পোজিট মিলসের পরিচালক নাসির উদ্দিন মিয়া, এনামুল হক, ওয়ান টেক্সের পরিচালক আবেদ হাসান মাহমুদ এবং ওয়ান স্পিনিং মিলসের পরিচালক এএইচএম জাহাঙ্গীর।
২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর ক্যান্টনমেন্ট থানায় এ মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১০ সালের ৬ জুলাই তারেক রহমান এবং গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়। ২০১১ সালের ৮ আগস্ট এ মামলায় তারেক এবং মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে আদালত।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য নির্মাণ কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের মালিক খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা নেন। সিঙ্গাপুরে এই টাকা লেনদেন হয়।
এরপর মামুন ওই অর্থ সিঙ্গাপুরের ক্যাপিটাল স্ট্রিটের সিটি ব্যাংক এনএ-তে তার নামের ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। এ টাকার মধ্যে তারেক রহমান ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা খরচ করেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
২০১১ সালের ২৩ জুন অপর একটি অর্থপাচার মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো এবং সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেনের ছেলে ইসমাইল হোসেন সায়মনকে ৬ বছর করে সশ্রম কারাদ- দেয় একই আদালত। এছাড়াও তাদের ৩৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল।
২০০৮ সালের মে মাসে কোকো সরকারের নির্বাহী আদেশে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে বিদেশে চিকিৎসা করাতে যান। এরপর তাকে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য আদালত আদেশ দিলেও তিনি ফিরে না আসায় তাকে পলাতক দেখিয়ে ওই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছিল।