বাংলাদেশের চিংড়িশিল্পে নিয়োজিত ১২ লাখ শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারকে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার, বড় বড় খুচরা বিক্রেতা ও গ্রাহকদের চাপ দেওয়া উচিত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরিবেশ ও মানবাধিকার রক্ষা বিষয়ক অলাভজনক সংস্থা ‘এনভায়রনমেন্টাল জাস্টিস ফাউন্ডেশন’ (ইজেএফ) এমনটাই মনে করে বলে জানিয়েছে।
গার্ডিয়ান অনলাইনে ইজেএফের এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘ইম্পসিবলি চিপ: অ্যাবিউজ অ্যান্ড ইনজাস্টিস ইন বাংলাদেশ শ্রিম্প ইন্ডাস্ট্রি’। এতে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের চিংড়িশিল্পের শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা।
ইজেএফের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চিংড়ি রপ্তানিকারী শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। পোশাকশিল্পের পরে এই খাত থেকেই দেশে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। কিন্তু চিংড়িশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকেরা খুবই দরিদ্র। চিংড়িশিল্প কারখানার পরিবশে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কারখানায় শিশুদের নিয়োগ করা হয়, বেতন কম দেওয়া হয়, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার আইন চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়। এসব কারখানায় একে তো শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষ খারাপ আচরণ করে, উপরন্তু শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডের ওপরও বিধিনিষেধ জারি করা হয়। অতিরিক্ত কাজ করানো হলেও শ্রমিকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেয় না মালিকপক্ষ। অর্থাত্ চিংড়িশিল্প কারখানাগুলোতে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চিংড়ি উত্পাদন ও সংগ্রহকারীরা প্রচণ্ড আর্থিক সংকটে থাকেন। ভবিষ্যতের জন্যও তাঁদের কোনো সঞ্চয় থাকে না।
শ্রমিকদের অবস্থা বোঝাতে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে তাসলিমা নামের এক খামারকর্মীর কথা।
চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কাজে নিয়োজিত শ্রমিক তাসলিমা বলেন, কাজের সময় তিনি হাতে কোনো দস্তানা পরেন না। দস্তানা না পরায় কাজ করতে গিয়ে তাঁর হাত ফুলে যায়। রক্ত পড়ে। যদি কারখানায় প্রাথমিক চিকিত্সার ব্যবস্থা থাকত তাহলে তাঁদের জন্য ভালো হতো। কিন্তু কারখানায় তা নেই। তিনি বলেন, হাতে ক্ষত হলে তাঁদের নিজেদেরই ওষুধ কিনতে হয়। তাসলিমা বলেন, ‘যখন কাজ থেকে বাড়ি ফিরি তখনো আঙুল ফুলে থাকে। কোনো কিছু ধরতে পারি না।’
ইজেএফের নির্বাহী পরিচালক স্টিভ ট্রেন্ট বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সামুদ্রিক খাবার বিক্রি করে বাংলাদেশ কোটি কোটি ডলার আয় করে কিন্তু কারখানার কর্মপরিবেশ থাকে আতঙ্কজনক। লাভের কোনো হিস্যাই শ্রমিকদের পকেটে যায় না। কারখানার ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীই লাভের পুরোটা ভোগ করে।
ইজেএফের হিসেবে, চিংড়িশিল্পে সরাসরি ১২ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। তবে পরোক্ষভাবে ৪৮ লাখ শ্রমিক এই শিল্পের ওপর নিভর্রশীল। সরকারি হিসেবের বাইরেও বাংলাদেশে অনেক নিবন্ধনহীন চিংড়িশিল্প রয়েছে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে পরিচালিত চিংড়িশিল্পও আছে। দেশের জিডিপিতে চিংড়িশিল্প ৪ শতাংশ অবদান রাখে। অথচ স্থানীয় পর্যায়ে এই শিল্প দারিদ্র্য দূরীকরণ ও উন্নয়নে সামান্যই ভূমিকা রাখতে পারছে।
স্টিভ ট্রেন্ট বলেন, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য বাংলাদেশের সরকারকে আরও বেশি চাপ দিতে হবে। এ ব্যাপারে ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ডিএফআইডি) উচিত বাংলাদেশের ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় প্রসিদ্ধ চিংড়িশিল্প কারখানাগুলোকে বেশি চাপের মধ্যে রাখতে হবে বলে মনে করেন ট্রেন্ট। তিনি বলেন, চিংড়িশিল্পে কমর্রত শ্রমিকেরা যাতে ভালো থাকতে পারে সে জন্য বড় খুচরা বিক্রেতাদের চাপ দিতে হবে।
ইজেএফের মতে, পণ্য আমদানির সময় পশ্চিমা দেশগুলো খাদ্য নিরাপত্তা, গ্রাহকদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা রক্ষার দিকটি যেমন দেখবে তেমনি কারখানায় শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা হচ্ছে কি না বা মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা সেটিও বিবেচনা করবে। ট্রেন্ট মনে করেন পরিস্থিতি উন্নয়নের এখনো সুযোগ আছে।