কিংবদন্তীতুল্য নায়িকা প্রয়াত সুচিত্রা সেনের পাশে ছিলেন ডাক্তার সুব্রত মৈত্র। তার জবানিতেই শোনা যাক প্রিয় নায়িকার শেষ দিনগুলোর কথা
‘নতুন বছর তো পড়ে গেল বাড়ি যাব কবে?’
২৩ ডিসেম্বর,২০১৩: আজ বিকালে মিসেস সেনকে পরীক্ষা করে ভাল লাগল না। কফটা এতটা শুকিয়ে গিয়েছে যে কাশির সঙ্গে উঠছে না। শীতের এই সময়টা বয়স্ক মানুষদের পক্ষে বেশ সমস্যা। চেম্বারেও নিউমোনিয়ার রোগী পাচ্ছি বেশ কিছু। সময়ে যথাযথ চিকিত্সা শুরু না হলে এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। তাই হাতজোড় করে বললাম, এবার আর আপত্তি করবেন না। ওষুধ তেমন রেসপন্স করছে না। কিছু দিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। উনি পরিস্থিতিটা বুঝেছিলেন। কষ্টটাও বাড়ছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। মুনমুন বলেছিলেন, “ডক্টর, মাই মাদার ইজ আ ভেরি পার্সোন্যাল লেডি। ওঁর অন্তরাল যাতে মেনটেনড হয় সেটা নজরে রাখবেন প্লিজ।” বেলভিউয়ের মিস্টার টন্ডনকে জানিয়ে দেয়া হল তিন তলায় মিসেস সেনের প্রিয় কেবিনটা রেডি রাখার জন্য। প্রায় মাঝরাতে বাড়ির গাড়িতেই আনা হল ওঁকে।
২৫ ডিসেম্বর: অন্য দিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছিলেন। নার্সকে মজা করে বললেন, “হাসপাতালে কেক খাওয়ানো হয় না?” পরীক্ষা করে দেখলাম রক্তচাপ স্বাভাবিক। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ ৮৮। খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম সকলেই।
২৯ ডিসেম্বর: আজ সকাল থেকে ঠিকই ছিলেন। আগামীকাল ছানি অপারেশন। আই হসপিটাল থেকে ডাক্তার আসবেন। তা নিয়ে অল্পবিস্তর রসিকতাও হল। আমি বললাম, “ম্যাডাম! আপনার চোখে ছুরি-কাঁচি চালানো তো! একটু অভয় দেবেন!” উনি খুব হাসলেন! কিন্তু সন্ধ্যে থেকে আচমকা শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল। রাতে কেবিন থেকে আইসিইউতে স্থানান্তর করতে হল। অক্সিজেন-স্যালাইন শুরু করতে হল পুরোদমে। তার আগে থেকেই বারবার বলছিলেন, ”সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে তো?” স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে টেনশন করছিলেন।
৩০ ডিসেম্বর: মিসেস সেনের শরীর প্রচণ্ড দুর্বল। টানা অক্সিজেন আর স্যালাইন চলছে। ছানি অপারেশনের প্রশ্নই নেই। সারাদিনই টেনশনে কাটল। বাড়ি ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল।
৩১ ডিসেম্বর: আজও ম্যাডামের শরীরটা একেবারে ভাল নেই। অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ হওয়ার মুখে। তাও উন্নতি নেই কেন? টেনশন বাড়ছে আমাদের। ওঁর মেয়ে আর দুই নাতনী আজ অনেকক্ষণ ছিলেন। বছর শেষের পার্টি ছিল ডাক্তারদের। সব বাতিল করে মেডিক্যাল বোর্ডের সবাই হাসপাতালেই মাঝরাত পার করে থাকলাম।
১ জানুয়ারি, ২০১৪: তুলনামূলক ভাবে সকালের দিকে ভাল আছেন। জানতে চাইলেন, “আজ কল্পতরু উত্সব, না?” রাতে মিশন থেকে প্রসাদ এল। হাত ছুঁয়ে কপালে ঠেকালেন। এ ক’দিনেই মুখে যন্ত্রণার ছাপ পড়েছে। কয়েকটা আধ্যাত্মিক বই চাইলেন পড়ার জন্য। সারদা মায়ের জীবনী এনে দিলাম। আমি একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রয়েছি। উনি সেটা জানেন। সেখানে কাজকর্ম কেমন চলছে, কী রকম রোগী আসছে জানতে চাইলেন।
৩ জানুয়ারি: শারীরিক অবস্থার ওঠানামা চলছে। রক্তে অক্সিজেন কখনও ৮৮, আবার তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ৭৮। তারই মধ্যে জানতে চাইলেন, “নতুন বছর তো পড়ে গেল। বাড়ি যাব কবে?” আজ সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হাসপাতালে এসেছিলেন। ম্যাডামের অবস্থার খোঁজ নিলেন। তবে আইটিইউ-তে ঢোকেননি। সন্ধ্যায় আমাদের টিমের চিকিত্সক সমরজিত্ লস্করের সঙ্গে কথা বলছিলেন ম্যাডাম। আবেগপ বণ হয়ে পড়ছিলেন। বললেন, “তুমি তো তোমার মাকে খুব ভালবাসো। আমাকে মা বলে ডাকতে পারো।” সমরজিত্ কেঁদে ফেলেছিলেন। আমরাও সামলাতে পারিনি।
৪ জানুয়ারি: মেডিক্যাল টিমে আজ পবন অগ্রবাল আর ধীমান গঙ্গোপাধ্যায়কে নেয়া হল। ফুসফুসের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। আমরা মেডিক্যাল টিমের একটা শিডিউল তৈরি করে নিলাম। তা না হলে অন্য রোগীদের পরিষেবা ঠিকঠাক দেয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তারদের দু’টো টিম করা হল। এক জন শুধু ম্যাডামের বিষয়টা দেখবে। কোনও এক জন চিকিত্সককে সব সময় রোটেশনে তাঁর কেবিনে রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত হল।
৫ জানুয়ারি: দুপুরের পর মিসেস সেন একটু ভাল। মমতাদি (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) এসেছিলেন জেনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন। তার পর বললেন, “আমার সঙ্গে দেখা করল না কেন?” মিসেস সেনের থেকে এই কথাটা অপ্রত্যাশিত। সঙ্গে সঙ্গে মমতাদিকে ফোন করলাম। বিকালে বাড়ি থেকে হাসপাতালে চলে এলেন দিদি। প্রায় আধ ঘণ্টা দু’জনের একান্তে কথা হল। নিজেদের মধ্যে আমরা আলোচনা করছিলাম, অবশেষে কি অন্তরাল ভাঙলেন সুচিত্রা সেন?
৬ জানুয়ারি: বুকের কফ উঠছিল না। ওঁকে জানালাম চেস্ট ফিজিওথেরাপি করতে হবে। বুকের কফ যখন ওষুধ বা ইঞ্জেকশনেও তোলা যায় না, তখন বুকে বিশেষ পদ্ধতিতে মালিশ করা প্রয়োজন হয়। তাতে হাতেনাতে ফল মেলে। উনি তো শোনামাত্রই প্রবল আপত্তি করলেন। শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে হাসপাতালের এক মহিলা ফিজিওথেরাপিস্টকে ওঁর ঘরে আনলাম। কিছুক্ষণ কথা বললেন তাঁর সঙ্গে। আধ ঘণ্টার মতো ফিজিওথেরাপি হল। তাতে কফ উঠল অনেকটা।
৮ জানুয়ারি: শ্বাসকষ্ট চরমে উঠেছিল। মুনমুনকে জানালাম, ভেন্টিলেশন দরকার। কিছুতেই রাজি হলেন না। ওঁর ধারণা ছিল, একবার ভেন্টিলেশনে দিলে মা আর বেরোবে না। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন বা বাইপ্যাপ চলবে। এতে মুখে একটা মাস্ক পরিয়ে অক্সিজেন খুব জোরে ফুসফুসে প্রবেশ করানো হয়। ভেন্টিলেশনে যেমন মুখের মধ্য দিয়ে নল ঢোকানো হয়, এটা তার থেকে আলাদা।
৯ জানুয়ারি:হাসপাতালে ঢোকা-বেরোনোই মুশকিল হয়ে উঠেছে। ঝাঁকে-ঝাঁকে রিপোর্টার আর ক্যামেরা। চিকিত্সকদের দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। ওঁদের কাজ ওঁরা করবেনই। আমরা ডাক্তারেরা পড়ি উভয়সঙ্কটে। এক দিকে রোগীর শারীরিক অবস্থা কাউকে না বলার নৈতিক দায়িত্ব। অন্যদিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে তাঁদেরও কিছুটা তথ্য জানানোর চাপ। আমি মোবাইলটাই বন্ধ করে দিয়েছি। এতে অন্য রোগীদের অসুবিধা হচ্ছে। তাঁরা তাঁদের প্রয়োজনে সব সময়ে আমাকে পাচ্ছেন না।
১০ জানুয়ারি: আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন। কিছুটা ওষুধ দিয়ে আমরা ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করছি। তবে সামনে গিয়ে পরিচয় দিলে চিনতে পারছেন। সন্ধ্যায় মমতাদি আবার এলেন। ঘরে ঢুকতে কিছুটা আচ্ছন্ন অবস্থাতেই ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি আমার কে হও?” আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন মমতাদি। হাত ধরে ছিলেন অনেক ক্ষণ। কী খেতে ইচ্ছা করছে জানতে চাওয়ায় বললেন, ফুচকা।
১১ জানুয়ারি:আক্ষরিক অর্থে যমে-মানুষে টানাটানি চলছে আজ। সন্ধ্যায় এন্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব পরাতে গিয়ে গলা থেকে একটু রক্ত বার হল। খুব যন্ত্রণা পেয়েছেন। ম্যাডামকে কথা দিয়েছিলাম, কোনও কষ্ট হবে না। রাখতে পারলাম না। এত বয়স্ক এক জন মানুষের উপরে কোনও চিকিত্সা প্রয়োগের আগে অনেক বার ভাবতে হয়। তার উপরে আবার না খেয়ে খেয়ে ওঁর যা কাহিল অবস্থা! মিসেস সেনের নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্টের পরিমাণ বাড়ানো হল। রাইলস টিউবও পরানো হল। কারণ না খেলে বুঝতে পারবেন না।
১৪ জানুয়ারি: খবরের কাগজে অজস খবর বার হচ্ছে ম্যাডামকে নিয়ে। আমরা এবং বাড়ির লোকেরা সব মিলিয়ে ক্লান্ত, বিব্রত। মুনমুন দুপুরে এসেছিলেন। অত্যন্ত বিরক্ত। মেডিক্যাল টিমের সবাইকে ডেকে বললেন, “আপনারা ‘হিপোক্র্যাটিক ওথ’ নিয়ে এই পেশায় এসেছেন। আমার মা নিজের ব্যাপারে এত দিন যে গোপনীয়তা রক্ষা করে এসেছেন তা বজায় রাখার দায়িত্ব আপনাদেরও। আমি চাই না উনি কী খাচ্ছেন, কী বলছেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবরের কাগজে বেরোক।”
১৬ জানুয়ারি: কিছুতেই ওষুধ খেতে চাইছেন না। বারেবারে বলছেন, “আগে বাড়ি যেতে দাও। তার পর ওষুধ খাব।” প্রচণ্ড অভিমানী হয়ে পড়েছেন। নিজের ব্যক্তিগত নার্সকেও কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না। ওঁকে ভীষণ অস্থির, অন্য রকম লাগছিল। রাতে জোর করেই বাইপ্যাপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। আমরা নিজেরাই দ্বিধায় ছিলাম। নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন বা বাইপ্যাপে হার্টের উপরে খুব চাপ পড়ে। উনি সেই চাপটা নিতে পারবেন তো? শেষ বারের মতো চেষ্টা করলাম টোটাল ভেন্টিলেশনের ব্যাপারে ওঁকে এবং মুনমুনকে রাজি করানোর। কেউই রাজি হলেন না।
১৭ জানুয়ারি: কাল বাড়ি ফিরতে রাত একটা হয়েছে। খুব খুব টেনশন হচ্ছিল। মিসেস সেন একেবারে ভাল ছিলেন না। নস্করকে বলে এসেছিলাম। সকাল সাতটায় হাসপাতাল থেকে ফোন। অবস্থা খুব খারাপ। কী ঘটতে চলেছে বুঝতেই পারছিলাম। কোনও মতে দৌড়লাম। পালস রেট কমছিল। আটটার কাছাকাছি সময়ে ম্যাসিভ অ্যাটাক। বুঝে গেলাম, আর কিছু করার নেই। গত দু’দিন ক্রমাগত বলে যাচ্ছিলেন, “আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও তোমরা।” ডাক্তার হিসাবে তো ছাড়তে পারা যায় না। শেষ পর্যন্ত উনিই নিজে ছেড়ে চলে গেলেন আর আমাদের সেই সারসত্য বুঝিয়ে গেলেন যে, চাইলেই কাউকে ধরে রাখা যায় না।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা