একাত্তরে অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা-না করার প্রশ্নে শুরু করা তদন্তকাজ শেষ পর্যায়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় আগামী মাসে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিক চার্জ গঠনের পর এপ্রিল বা মে মাসে বিচারকাজ শুরু হতে পারে।জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ পর্যায়ে
ট্রাইব্যুনালে কোনো সংগঠন বা দলকে বিচারের মুখোমুখি করা হলে অপরাধ প্রমাণের পর দল বা সংগঠনের শাস্তি কী হবে, তা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে উল্লেখ নেই। শুধু ব্যক্তির শাস্তির কথা বলা আছে।
এ কারণে ট্রাইব্যুনালে অপরাধী প্রমাণিত কোনো সংগঠনের শাস্তি সুনির্দিষ্ট করতে হলে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। এখনও এই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেই। সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনকেও বিচারের আওতায় আনা হয়।
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই গত বছরের ১৭ আগস্ট থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যথেষ্ঠ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাসে যারা জামায়াতের অপরাধ ও নির্যাতনমূলক কার্যকলাপ স্বচক্ষে দেখেছেন, দেশে বা বিদেশে অবস্থানরত সেই প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক সমকালকে বলেন, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন। তাদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আগামী মাসে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। তদন্ত কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান সমকালকে একই কথা বলেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে জামায়াত-শিবির বেশ কিছুদিন ধরে নানা তৎপরতা, যথা- সন্ত্রাসী হামলা, ঝটিকা মিছিল, মানুষ হত্যা করে আসছে। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া, রাস্তার গাছ কাটা, ভোট দিতে মানুষকে বাধা দেওয়া ও নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালাচ্ছে জামায়াত-শিবির।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের আইনগত সুযোগ এ মুহূর্তে না থাকায় কিছুই করা যাচ্ছে না।
আইনজীবীরা জানান, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের (গ) ও (ঘ) উপ-অনুচ্ছেদ, রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭২ ও দ্য পলিটিক্যাল পার্টিজ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮-এর বিধিবিধান অনুসরণ করে যে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নিষিদ্ধ করা যায়। দ্য পলিটিক্যাল পার্টিজ অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮-এর ৩ ও ৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ববিরোধী কার্যকলাপ করতে পারবে না।
কোনো রাজনৈতিক দল সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে গোপন তৎপরতাও চালাতে পারবে না।
গত বছরের ১৫ জুলাই ট্রাইব্যুনাল-১ গোলাম আযমকে ৯০ বছরের সাজা দেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, জামায়াত অপরাধী সংগঠন। একাত্তরে তাদের ভূমিকা ছিল দেশের স্বার্থের পরিপন্থী। রায়ের অভিমতে বলা হয়, দলটি গত ৪২ বছরেও তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায়নি বা অনুশোচনা করেনি।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ চেয়ে আপিল করেছে সরকার। ওই আপিলে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জন্যও আবেদন জানানো হয়। আপিল বিভাগে এ আপিল আবেদনটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল চেয়ে তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিবসহ ২৫ জনের করা রিট আবেদনের রায়ে জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বেআইনি ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।
নিষিদ্ধ সংগঠন : ২০০৫ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশকে (জেএমবি) নিষিদ্ধ করেছিল। এরপর হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করা হয়। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত থাকার কারণে এ দুটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়।
একই অপরাধে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে বাধা থাকার কথা নয় বলে মনে করেন আইনজীবীরা। মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় জার্মানির নাৎসি পার্টির নেতাদের শাস্তির পাশাপাশি দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয় নুরেমবার্গ ট্রায়ালে।