না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তম নায়িকা সুচিত্রা সেন। হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার সকাল ৮.২৫ মিনিটে মধ্য কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতাল (বেল ভিউ ক্লিনিক)-এ শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা চলচ্চিত্রের এই জনপ্রিয়তম নায়িকা। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ফুসফুসে সংক্রমণজনিত কারণে গত ২৪ ডিসেম্বর এই হাসপাতালে ভর্তি হন সুচিত্রা সেন। মৃত্যুকালে রেখে গেলেন কন্যা মুনমুন সেন এবং দুই নাতনি রাইমা ও রিয়া সেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে টানা ২৫ দিন ধরেই তার শারীরিক অবস্থার চড়াই উতরাই হতে থাকে। তার স্বাস্থ্যের খবর নিতে প্রায় প্রতিদিনই পালা করে সুচিত্রা সেনকে দেখতে হাসপাতালে আসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। এছাড়াও এসেন সিপিআইএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, রবীন দেব, অঞ্জন বেরা, পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য, বেলুড় মঠের ভরত মহারাজ সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রিয় নায়িকার স্বাস্থ্যের খোঁজে হাসপাতাল চত্তরেও প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষের ভিড় লেগে থাকত। সেই অভিনেত্রীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই চলচ্চিত্র জগতে নেমে আসে শোকের ছায়া। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে শিল্পী, কলাকুশলী,রাজনীতিবিদ প্রত্যেকেই। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পাবনা-য় (বর্তমান বাংলাদেশ) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন করুণাময় দাসগুপ্ত। তাঁর মায়ের নাম ছিল ইন্দিরা গাশগুপ্ত। তিনি সংস্কৃতি প্রেমি মহিলা ছিলেন। তখনকার রক্ষণশীল সমাজে স্কুল জীবনেই সুচিত্রা সেনকে নাচ, গান ও অভিনয় উত্সাহ দিয়েছিলেন তাঁর মা। করুনাময়বাবু পাবনা শহরে স্বাস্থ্য কর্মী ছিলেন। বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তান ছিলেন সুচিত্রা। পাবনা শহরে মহাকালি পাঠশালায় তাঁর স্কুল শিক্ষার সুত্রপাত হয়। স্কুল ছাত্রী থাকাকালীন তাঁর মধ্যে সাংস্কৃতিক কাজকর্মে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতা ছিলো। তিনি ভাল গান গাইতে পারতেন, নাচতে পারতেন ও নাটকে অভিনয়ে ছিলেন সাবলীল। তাঁর আসল নাম ছিল কৃষ্ণা দাশগুপ্ত। পরে তাঁকে রমা নামেও ডাকা হতো। সিনেমা জীবনে তিনি সুচিত্রা নামে পরিচিত হন। ১৯৪৬ সালে কলকাতার সামপ্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় পাবনা সহ পূর্ব বাংলার অনেক শহরে সামপ্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সেই সময় কৃপাময় দাশগুপ্ত তাঁর স্ত্রী সন্তনদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বোলপুরের ভুবনডাঙ্গায় এসে নতুন জীবন শুরু করেন। সুচিত্রা সেন চার বছর শান্তিনিকেতনে পড়াশুনাও করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে বাংলার বিশিষ্ট শিল্পপতি দিবানাথ সেন-এর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন সুচিত্রা। ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবিতে তাঁর প্রথম অভিনয় শুরু হলেও ওই ছবিটি মুক্তি পায়নি। ১৯৫৩ সালে তাঁর প্রথম মুক্তি প্রাপ্ত বাংলা ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’। ঐ বছরেই উত্তম কুমারের সঙ্গে তাঁর প্রথম মুক্তি প্রাপ্ত ছবি ‘সাড়ে চুড়াত্তর’। সেই ছবিটিই বক্স অফিসে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। তারপর থেকে আর সুচিত্রাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর শাপমোচন, সবার উপরে, মরণের পারে, প্রণয় পাশা, সাত পাকে বাঁধা, সপ্তপদী, দ্বীপ জেলে যাই, মেজো বউ, হারানো সুর, জীবন তৃষ্ণা, মুসাফির, চম্পাকলি, বোম্বাই কা বাবু, সহ বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ অসাধারণ হিট করার পর বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে সুচিত্রা-উত্তম যুগের সুচনা হয়েছিলো। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের মহানায়ক উত্তম কুমারের সাথেই তিনি সবচেয়ে বেশি অভিনয় করেছিলেন। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই জুটি বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে হিন্দি ভাষায় ‘দেবদাস’ ছবিতে অভিনয় করেন সুচিত্রা সেন। ১৯৭৪ সালে ‘আঁঁধি’ আমে আরেকটি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। এই ছবিতে একজন রাজনীতিকের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল সুচিত্রাকে। উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর শেষ অভিনীত ছবি হীরেন নাগ পরিচালিত ‘প্রিয়বান্ধবী’, সেটি মুক্তি পায় ১৯৭৫ সালে। সুচিত্রা সেনের শেষ অভিনীত ছবি ‘প্রণয় পাশা’ ১৯৭৮ সালে মুক্তি পেলেও তেমন চলেনি। সুচিত্রা সেন যুগের আগে কানন দেবী, যমুনা, সন্ধ্যারানী সহ বহু অভিনেত্রী বাংলার ছবিকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। একইভাবে সুচিত্রা সেনের সমসাময়িক সুপ্রিয়া দেবী, মালা সিনহা, অরুন্ধতী, সাবিত্রী, অর্পণা সেন, মাধবী সহ অনেক অভিনেত্রী রেখাপাত করলেও কেউই সুচিত্রা সেনের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন, কন্যা-জামাতা, দুই নাতনি ও ঘনিষ্ঠ পরিচিত কিছু মানুষ ছাড়া কেউই সুচিত্রার নাগাল পান না। ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে তিনি প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে ১৯৬৩ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। জনসমক্ষে আসবেন না বলে ২০০৫ সালে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেছিলেন সুচিত্রা সেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করেছিল। সেসময় মেয়ে মুনমুন সেন তাঁর মায়ের হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন।