মুখ খুললেই গ্রেফতার হচ্ছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। রাজপথে নামলেই হচ্ছেন ধড়পাকড়ের শিকার। সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশন তো আছেই। এ অবস্থায় চরম আতঙ্কে রয়েছেন প্রধান এই বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। দশম সংসদ নির্বাচনের পরও পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি, বরং আরও কঠিন হচ্ছে। মঙ্গলবারই গ্রেফতার করা হয়েছে দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, দলের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন এবং এমপি নাজিমউদ্দিন আহমেদকে। প্রেসক্লাবে কথা বলার পরপরই গ্রেফতার হন খন্দকার মাহবুব হোসেন। সন্ধ্যায় দলের কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই নিজ বাসা থেকে আটক হন সেলিমা রহমান। এছাড়া বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টর মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আসম হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম, সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদসহ দুই ডজন নেতা। এ প্রেক্ষিতে আজ এ-বাসা কাল ও-বাসা করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খানসহ সক্রিয় সব নেতা। দীর্ঘদিন ধরে নির্জন-ভুতুড়ে অবস্থায় পড়ে আছে নয়াপল্টনের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এক রকম অবরুদ্ধ হয়ে দিন কাটাচ্ছেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজেও। এ অবস্থায় চরম কোণঠাসা হয়ে আছে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি। এ গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। মুখ খুললে অথবা রাস্তায় নামলে গ্রেফতার, অতঃপর জুটে যাচ্ছে পুরনো একাধিক মামলা। এসব মামলায় নেয়া হচ্ছে রিমান্ডে। বেশ কিছুদিন থেকে এমন কর্মকা- দলটির যেন নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন অবস্থায় বিভ্রান্ত দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
৩০ নভেম্বর ভোরের আলো ফোটার আগেই ‘কমান্ডো স্টাইলে’ অভিযান চালিয়ে বিএনপির দফতরের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে আটক করে নিয়ে যায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ বিএনপির এই মুখপাত্রকে আটক করতে ৩৫ মিনিটের অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৩০ সদস্য অংশ নেয়। শনিবার ভোর সোয়া ৪টায় তাকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। এরপর দায়িত্ব পান অপর যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু কয়েক দফা চেষ্টা করেও কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি তিনি। এর আগে থেকেই পুরো কার্যালয় ঘিরে রাখে পুলিশ। বাধ্য হয়েই অজ্ঞাত স্থান থেকে দল এবং জোটের পক্ষে বিবৃতি ও ভিডিও বার্তা প্রচার করেন তিনি। এসময় সালাহউদ্দিন আহমেদের খোঁজে তার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়ায় তল্লাশি চালায় পুলিশ। এরপর তাকে সরিয়ে সামনে আনা হয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে কয়েকদিন মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে তিনিও আত্মগোপনে চলে যান। এসময় আত্মগোপনে থাকা ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতাদের যথাযথ সমন্বয়ের অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বেশিরভাগ সদস্যের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় মুখপাত্রের দায়িত্বে আসেন স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. আরএ গণি, ড. আবদুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন, ড. এম ওসমান ফারুক, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান। এদের মধ্যে ২৫ ডিসেম্বর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে ড. আরএ গণিকে আটক করে পরে তার বাসায় নামিয়ে দেয়া হয়। এরপর থেকে তিনিও চলে যান আত্মগোপনে। একে একে আড়ালে চলে যান সিনিয়র নেতারা। ৩০ ডিসেম্বর দলের অবরুদ্ধ চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গুলশানের বাসার সামনে থেকে আটক হন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমানসহ আরও তিনজন। তবে বিকালে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। একই প্রক্রিয়ায় আটক হয়ে ছাড়া পান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমশের মবিন চৌধুরী। নির্বাচনের পর মঙ্গলবার দুপুরে প্রেসক্লাব থেকে আটক করা হয় অ্যাডভোকেট মাহবুব হোসেনকে। রাতে গুলশানের বাসায় সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণার পর আটক করা হয় সেলিমা রহমানকে।
এর মধ্য দিয়ে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের গ্রেফতারের জন্য সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেফতার অভিযানের পাশাপাশি মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ডিবির প্রধান কার্যালয়ের সামনে পুলিশ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জায়গায় নাশকতার যেসব মামলা হয়েছে সেসব মামলায় জড়িতদের গ্রেফতারে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানী ছাড়াও সারা দেশে গ্রেফতার অভিযানে একাধিক টিম কাজ করছে বলে জানা গেছে।
আন্দোলনের মাঠে বিএনপির অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সরকার বিএনপিকে কোনো কর্মসূচিই পালন করতে দেয় না, পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করে। এসব কারণে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কম দেখা যায়। এছাড়া বেশ কয়েকজন নেতা কারাগারে আছেন। বাকি নেতাদের অনেককেই পুলিশের ধরপাকড়ের মুখে আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে।