সমঝোতায় নয়া নির্বাচনের শর্তে বিদেশি সহযোগিতা

0
153
Print Friendly, PDF & Email

পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন স্পষ্টতই বিদেশি বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও জোটগুলোর কাছে ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ পায়নি। এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন হতে যাওয়া নতুন সরকারকে বিশেষ ধরনের একটি চাপে ফেলতে যাচ্ছে প্রভাবশালী এই বিদেশিরা। এতে সমঝোতার মাধ্যমে আগামীতে একটি ‘সর্বদলীয়’ নির্বাচনের শর্ত দিতে যাচ্ছে তারা। কূটনৈতিক সূত্র এ তথ্য জানায়। এদিকে নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নও একটি কঠোর ভাষার প্রতিক্রিয়া দেখাতে চলেছে বলে সূত্রের খবর। গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউয়িনের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়নি। তবে গত দুদিন ধরেই ঢাকায় দায়িত্বরত ইউরোপীয় দেশগুলোর আটজন রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার নিজেদের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করে নিজ দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতর ব্রাসেলসে একাধিক প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। এসব প্রতিবেদনের ছাপ থাকবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্রাসেলস দফতর থেকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশের পাশাপাশি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করে এসব বিদেশি শক্তিগুলো বলেছে, একটি অবাধ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে রাজনৈতিক নেতারা। নির্বাচনে জনসম্পৃক্ততা না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছে বিদেশিরা। তারা এখন দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে আবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। রাজনৈতিক সংঘাত বন্ধ করতে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর কার্যকর সংলাপের কোনো বিকল্প দেখছে না বিদেশি রাষ্ট্র, সংস্থা ও জোটগুলো। তাই সরকারের কাছেই তাদের আহ্বান, জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরুর। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডার বিবৃতিতে এই অভিন্ন অবস্থানের কথাই উঠে এসেছে। ভারতও এই নির্বাচনকে নিছক সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূরণের অংশ হিসেবেই অভিহিত করেছে।
ঢাকার পশ্চিমা একটি দেশের এক কর্মকর্তা গতকাল এই প্রতিবেদককে জানান, বাংলাদেশের গত কুড়ি বছরের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী বিশ্বাসযোগ্য একটি নির্বাচন খুবই প্রয়োজন ছিল। বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করে গণতন্ত্রের প্রতি যেমন শ্রদ্ধা দেখাতে পারেনি; তেমনি সরকারি জোটও বিরোধীদের নির্বাচনে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক উদ্যোগ নিলেও তার জোট বা নিজ দলের অন্যরা সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিলেন না বলেও মন্তব্য করেন ওই কূটনীতিক। তিনি বলেন, এখন নতুন একটি সরকার গঠন হবে, যা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তবে নয়া এই সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, খুব শিগগির দুই প্রধান জোটের মধ্যে একটি নির্বাচনের জন্য সমঝোতায় আসতে হবে। এই সমঝোতার ভিত্তিতে যতদ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচনেরও আয়োজন করতে হবে। এই শর্তগুলো নতুন সরকারের কাছে আমাদের দেশের তরফ থেকে দেয়া হতে পারে বলেও ওই কূটনীতিক জানান।
নির্বাচনের পর জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন নিউইয়র্ক থেকে গতকাল বিবৃতিতে তার হতাশার কথা জানিয়েছেন। ঢাকার জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরো সাদাশিমো গতকাল একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এর আগে লন্ডন থেকে কমনওয়েলথের মহাসচিব কমলেশ শর্মা, ব্রিটিশ সিনিয়র পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাঈদা ওয়ার্সি, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মেরি হার্ফ নির্বাচনে জনসম্পৃক্ততা না থাকায় হতাশার কথা জানিয়েছেন। এছাড়া কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন বেয়ার্ড উদ্বেগ ও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন তার দেশের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই সংঘাতের নিন্দা জানিয়েছেন তীব্রভাবে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র জানান, মহাসচিব বান কি মুন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে রাজনৈতিক মেরুকরণ ও স্বল্প অংশগ্রহণমূলক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এ সাধারণ নির্বাচনে প্রাণহানি ও সহিংস ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি সব পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মহাসচিব হতাশা প্রকাশ করেছেন, কেননা দলগুলো এমন কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি, যাতে একটি শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পাওয়া সম্ভব হয়, বলেন মুখপাত্র। জনসাধারণ যেখানে সমবেত হয়ে ও শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের মত প্রকাশের অধিকার চর্চা করতে পারেন, সর্বাগ্রে সে ধরনের শান্তিপূর্ণ ও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির তাগিদ দিয়েছেন তিনি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী ফল পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের মাধ্যমে যে ধরনের মতানৈক্য বা সমঝোতায় উপনীত হওয়া উচিত ছিল, তা না হওয়ায় হতাশ ও মর্মাহত বান কি মুন বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অবিলম্বে প্রধান দলগুলোকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অর্থবহ সংলাপ শুরুর তাগিদ জানিয়েছেন। বলেছেন, অংশগ্রহণ, অহিংসা, সমঝোতা ও সংলাপের ভিত্তিতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন দিয়ে যাবে জাতিসংঘ।
এক সময়ে ব্রিটিশ উপনিবেশে থাকা ৫৩ দেশের জোট কমনওয়েলথের মহাসচিব কমলেশ শর্মাও ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নিজের হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, কমনওয়েলথ সনদ অনুযায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রত্যেক ব্যক্তির অংশগ্রহণের অধিকারসহ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সমুন্নত রাখার বিষয়টিতে সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো ও সুশীল সমাজের দায়িত্ব রয়েছে। সে কারণে দ্রুত অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সামনে এগোনোর পথ খোঁজার জন্য আলোচনার ধারায় অগ্রসর হওয়া বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে জনগণের মতামত পুরোপুরি প্রতিফলিত হতে পারে।
নির্বাচনের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপ মুখপাত্র মেরি হার্ফ ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে দেয়া বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, আমরা বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধী দলকে অবিলম্বে সংলাপে বসার জন্য উত্সাহিত করছি যার মাধ্যমে তারা যত শিগগির সম্ভব একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খুঁজে বের করবে যেটি হবে অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য এবং যা বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। সেই সঙ্গে সব নাগরিক যাতে স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে পারে সেজন্য রাজনৈতিক পরিসর দেয়ার জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।

শেয়ার করুন