সমঝোতার মাধ্যমে শিগগিরই একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল। সর্বশেষ জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ বের করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতায় হতাশা জানিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে সহিংসতা বন্ধ করে সংলাপের মাধ্যমে দ্রুত নতুন নির্বাচনের উপায় বের করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কমনওয়েলথ, যুক্তরাজ্য ও কানাডা সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে তাদের স্পষ্ট অবস্থান জানিয়েছে। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন বলে উল্লেখ করেছে ভারত।
বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সহিংসতা সম্পর্কে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকরা বরাবর সোচ্চার থাকলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তারা কেউই মুখ খোলেননি। সদ্যসমাপ্ত এই নির্বাচন সম্পর্কে কোনো মন্তব্যও করেননি। তবে এ নির্বাচন সম্পর্কে এসব দেশের হেডকোয়ার্টার থেকেই এবার প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এই নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটার ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছিল না। তাই তারা দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে আরও একটি নির্বাচনের উপায় খুঁজে বের করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন। আর কোনো ধরনের সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে তারা।
জাতিসংঘ : জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে অর্থবহ সংলাপ শুরুর তাগিদ দিয়েছেন। সোমবার জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে তার মুখপাত্র এক বিবৃতিতে এ তাগিদ দেন। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মেরুকরণ ও কম অংশগ্রহণমূলক বলে চিহ্নিত হয়েছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ করে ব্যাপক প্রাণহানি ও সহিংসতার ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব মর্মাহত। যে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হওয়া সম্ভব ছিল, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে না পারায় হতাশ হয়েছেন বান কি মুন। এতে সবার আগে শান্তিপূর্ণ ও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে মানুষ সমবেত এবং শান্তিপূর্ণভাবে মত প্রকাশের অধিকারের চর্চা করতে পারে। তিনি বাংলাদেশের সব পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সহিংসতা এবং মানুষ ও সম্পত্তির ওপর হামলা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি জানান, বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক, অহিংস, সমঝোতা ও সংলাপের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন দিয়ে যাবে জাতিসংঘ।
যুক্তরাষ্ট্র : যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে হতাশা প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এই নির্বাচনের ফলাফলে জনগণের প্রত্যাশার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের উপ-মুখপাত্র মেরি হার্ফ সোমবার এক বিবৃতি সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পর্কে তাদের এই অবস্থান পরিষ্কার করেন। মেরি হার্ফ বলেন, সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন এবং বাকিগুলোর মধ্যে অধিকাংশ আসনেই নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। তাই এই নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশী জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। মেরি হার্ফ আরও বলেন, নতুন সরকারের রূপ কী হবে, সেটা ভবিষ্যতেই জানা যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার অঙ্গীকার অটুট থাকবে। আমরা বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধী দলকে অবিলম্বে সংলাপে বসার জন্য উৎসাহিত করছি। যাতে তারা যত শিগগির সম্ভব, একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খুঁজে বের করবে। আর সেটি অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে।
যুক্তরাজ্য : বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য সরকারও। দেশটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস সৈয়দা হুসেইন ওয়ার্সি সোমবার এক বিবৃতিতে এ হতাশার কথা জানান। তিনি জানান, এই নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি, যা ভোট পড়েছে তাও অনেক কম, যাতে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। তাই জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সহিংসতামুক্ত, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে কাজ করার আহবান জানান তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের বিধান অনুযায়ী নির্বাচনের ঘোষিত ফলাফল আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। একটি পরিপক্ষ ও কার্যকর গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রমাণ হল শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। যাতে সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও যুক্তরাজ্য বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক হয়রানি, সহিংসতা ও সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ জানান সৈয়দা ওয়ার্সি। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধিশালী ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য যুক্তরাজ্য সব ধরনের সহায়তা দেবে বলেও আশ্বাস দেন ওয়ার্সি।
চীন : ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত মঙ্গলবার ভাসানী অনুসারী পরিষদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। তিনি জানান, এই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলসহ বেশির ভাগ দল অংশ নেয়নি এবং অধিকাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। এই নির্বাচনকে কেন্দ করে সংঘটিত সহিংসতা গণতন্ত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যেভাবে ধ্বংস করেছে, তাতে চীন উদ্বিগ্ন। সরকার ও বিরোধী দল আন্তরিক হলে এই সংকটের সমাধান সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভারত : এদিকে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অংশ। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি হবে এবং কারা জনপ্রতিনিধিত্ব করবেন তা বাংলাদেশের জনগণই তা নির্ধারণ করবে। তিনি বলেন, সহিংসতার পথে কোনো সমাধান আসে না। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব গতিপথে চলতে দিতে হবে।
কমনওয়েলথ মহাসচিব : ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে সোমবার দেয়া এক বিবৃতিতে কমনওয়েলথের মহাসচিব কমলেশ শর্মী হতাশাজনক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে সীমিত সংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণ জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন নয়। তাই দ্রুততার সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার লক্ষ্যে সংলাপ শুরু করার তাগিদ দেন। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সহিংসতা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কানাডা : কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন বেয়ার্ড সোমবার দেয়া এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফলে হতাশা জানিয়েছেন। এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হওয়ায় তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে বেশির ভাগ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এবং বাকিগুলোতে বেশির ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ না করায় তিনি অবাক হয়েছেন। তবে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জাপান : বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশে ভোটাধিকারের সুযোগ প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছে জাপান। ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্র্রদূত শিরো সাদোশিমা মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ আহবান জানান। এছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতা ও জনগণের প্রতি সব ধরনের হুমকির কড়া নিন্দা জানান তিনি। তিনি বলেন, সংঘাত ও ভীতিমুক্ত রাজনৈতিক মতামত প্রকাশে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশার বিষয়ে জাপান অবহিত। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের উচিত জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়া। গত কয়েক মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেকের প্রাণহানির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানান তিনি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংস হামলা ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আক্রমণের ঘটনায় অসন্তোষ জানান তিনি। এছাড়া দশম জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় পৌঁছতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রদূত শিরো সাদোশিমা।