জামায়াত ভোট ভণ্ডুলে সফল তিন কারণে

0
119
Print Friendly, PDF & Email

‘ভোট তো ঠেকিয়ে দিলাম। প্রশাসন আর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে আসা দূরের কথা দপ্তর আর ঘর থেকেই বের হতে পারেনি। ভোট ঠেকিয়ে আমরাই জিতে গেছি।’ ভোটের পরদিন গতকাল সোমবার গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে এক জামায়াত নেতা বেশ দম্ভ আর

উচ্ছ্বাস নিয়েই বললেন কথাগুলো। উচ্ছ্বাসের কারণ এদিন ৫ জানুয়ারির ভোট ভণ্ডুলের উৎসবে মেতেছিল তারা।

স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা, আওয়ামী লীগের পিঠটান এবং সরকার ঘনিষ্ঠ জাতীয় পার্টির প্রশ্রয়ের কারণেই জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবকবলিত গাইবান্ধা জেলায় একে একে ২০৭টি ‘শূন্য’ পেয়েছে নির্বাচন কমিশন। অন্তত জেলার নির্বাচনী আসনগুলোর ফল বিবরণীতে এমন ‘শূন্য’ই দেওয়া আছে। একমাত্র জেলা হিসেবে এখানে তিনটি আসনের বাতিল হওয়া কেন্দ্রগুলোতে পুনরায় ভোট হবে।

প্রধানত জামায়াত-শিবিরের উগ্র বাধার মুখেই রবিবারের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই কেন্দ্রগুলোতে ভোট হয়নি। এর মধ্যে বেশির ভাগ কেন্দ্রে ভোটের সরঞ্জামই পাঠায়নি প্রশাসন। আবার অনেক কেন্দ্রে সরঞ্জাম পেঁৗছালেও মার খেয়ে হামলার মুখে ভোটের তল্পিতল্পা ফেলে ফিরে আসে পুলিশসহ নিয়োজিত জনবল। অবশ্য ব্যর্থতার জন্য গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে গতকাল সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রে ভোটের সরঞ্জাম না পাঠানো ও সহিংসতার মুখে ভোট বন্ধ রাখা প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শামস উল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রশাসন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে এমন অবস্থা হতো না। এটাকে প্রশাসনের ব্যর্থতাই বলতে হবে।’

জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও সাবেক এমপি আবদুর রশিদ সরকারও প্রায় একই ধরনের মত ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘মূলত আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জিতিয়ে দেওয়ার কারসাজির অংশ হিসেবেই প্রশাসন এই সাজানো ব্যর্থতা দেখিয়েছে। জামায়াত-শিবির যতই ঘেরাও করে রাখুক তা উপেক্ষা করে প্রশাসনের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া উচিত ছিল।’

প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গতকাল জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত উপজেলা হিসেবে পরিচিত সুন্দরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সামনে গতকাল কথা হয় সহকারী পুলিশ সুপার ফকরুজ্জামান জুয়েলের সঙ্গে। প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি প্রশাসনের ওপর ঢালাও ব্যর্থতার দায় না চাপানোর অনুরোধ করেন। এক ধরনের অভিমান ও আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘কী বলব ভাই, আমরা চাকরি করতে এসেছি। এখানে জীবনের মায়া করলে তো চলবে না। কিন্তু দায়িত্ব কি শুধু আমাদেরই? যেসব রাজনৈতিক দল বা মানুষ ভোটের পক্ষে ছিল তাদের কি কোনোই দায়িত্ব নেই! আমরা কোথাও ডেকেও তাদের পাই না। এমনকি যেসব কেন্দ্রে ভোট হয়েছে সেসব এলাকায়ও ভোটের পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সক্রিয়তা খুব একটা দেখা যায়নি। তাঁরা অনেকটাই যেন পালিয়ে বেড়ান।’

তরুণ পুলিশ কর্মকর্তাটি বলেন, ‘যেসব এলাকায় নির্বাচনবিরোধী সন্ত্রাসীরা তৎপর ছিল সেসব এলাকার নির্বাচনের পক্ষের অনেকের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। তাদের অনুরোধ করেছিলাম আমরা গেলে যেন তারাও এগিয়ে আসে। আমরা সবাই পরস্পরের সহযোগিতা পেলে সন্ত্রাসীরা টিকতে পারত না। ভোটাররা এসে ঠিকই ভোট দিতে পারতেন। কিন্তু তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।’

পাশে দাঁড়ানো আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে মেরে ফেলল, অথচ এলাকার কেউ এগিয়ে এলো না। আমরাও তো মানুষ। আমাদেরও তো পরিবার-পরিজন আছে।’

গাইবান্ধা পুুলিশের বিশেষ শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘২-১টি স্থানে কাকতালীয় ঘটনা ছাড়া কোথাও তো আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের কোনো অবস্থান বা তৎপরতা দেখি না। জামায়াতকে প্রতিহত করতে কেউ এগিয়ে আসে না। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই নিজেরা মারামারি করতে পারে। টেন্ডারবাজির সময়ও তো তারা কম যায় না। জামায়াতের বিরুদ্ধে তাদের সেই হম্বিতম্বি আর সাহস গেল কই? যেসব কেন্দ্র জামায়াত দখল করে নিয়েছিল সেখানে কি আওয়ামী লীগের লোকজন থাকে না? এমনকি আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাও তো ভোটকেন্দ্রগুলোর ধারেকাছে যাননি। কোনো কোনো প্রার্থী কেবল নিজ ঘরের দরজায় কোনোভাবে ভোট দিয়েই আবার ঘরে ঢুকে গেছেন।’

ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে পুলিশ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দেন জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ এক নেতা। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি আসনেই আমাদের দলের মধ্যে কোন্দল রয়েছে। এ কারণে আমরা সংগঠিত হতে পারছি না। নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে এই কোন্দল আরো চাঙ্গা হয়েছে। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কারো পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। সবাই গা বাঁচিয়ে চলে।’

দলীয় কোন্দলের কথা স্বীকার করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শামস উল আলম বলেন, ‘কোনো দলের সহায়তার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশাসন তাদের দায়িত্ব পালন করবে না_এটা কোনো কথা হতে পারে না। প্রশাসনের কাজ প্রশাসন করবে_এটাই তাদের দায়িত্ব। প্রশাসন সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সহিংসতা ঠেকাতে এবং মালামাল কেন্দ্রে না পাঠানোর মধ্য দিয়ে।’

অবশ্য পুলিশের বিরুদ্ধে জামায়াতকে মদদ দেওয়ার অভিযোগও করেন আওয়ামী লীগের কেউ কেউ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পলাশবাড়ী ও সুন্দরগঞ্জের দুই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘পুলিশের অনেকের সঙ্গে জামায়াতের সখ্য রয়েছে। জামায়াতের কাছ থেকে অনেক সুবিধা নেওয়ার কথাও এখানে প্রচার রয়েছে। অনেক সময়ই আমরা জামায়াতের অবস্থান ও তৎপরতা সম্পর্কে পুলিশকে অবহিত করলেও তারা তা আমলে নেয় না। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মার খেলেও সহসা পুলিশ ফিরে তাকায় না। এ ছাড়া সহিংসতায় জড়িত এবং বিভিন্ন গুরুতর মামলার আসামি জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-ছাত্রদলের অনেকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের ধরে না। কেউ কেউ সরাসরি সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ আরো একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেন।

ব্যর্থতার কারণ জানতে গতকাল সুন্দরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবীবের দপ্তরে গেলে দুপুর ১টায়ও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।

জামায়াতের সঙ্গে সখ্য রাখার অভিযোগ সম্পর্কে সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি কায়সার আলী খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কিছুক্ষণ আগেও সুন্দরগঞ্জের মীরগঞ্জ এলাকায় সন্ত্র্রাসীরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। সেখানে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আমাদের গোলাগুলি হয়। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনপন্থী কাউকে আমরা পাশে পাইনি। সখ্য থাকার অভিযোগ মিথ্যা।’

আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে সুন্দরগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আহসানুল কবীর চাঁদ বলেন, ‘২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত-বিএনপির কর্মীরা সন্ত্রাসী কায়দায় আমার বাড়িতে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করে। তবু আমি দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দলের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা বা উৎসাহ পাই না।’ তাঁর স্ত্রী ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজা বেগম কাকলী বলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের লাঠির ভয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমৃদ্ধ প্রশাসন ভোটকেন্দ্রেই যেতে সাহস করেনি। এটা কেমন কথা হলো!’

এদিকে পুলিশ প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও সাধারণ মানুষের অনেকেই জামায়াত-শিবিরের বেপরোয়া আধিপত্যের পেছনে বর্তমান সরকারে থাকা জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পরস্পর সহযোগিতার অভিযোগ করেন। তাঁরা জানান, আওয়ামী লীগের ভোট ঠেকাতে এখানে জাতীয় পার্টি-জামায়াত প্রায় একজোট। সেই অঙ্কের হিসাবে জামায়াতের সহিংসতার বিরুদ্ধে এখানে কখনোই পুলিশ বা আওয়ামী লীগের পাশে থাকে না জাতীয় পার্টি। তবে এবারের নির্বাচনের স্বার্থেও যদি কোনোভাবে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ এক হয়ে জামায়াতের ভোটবিরোধী সহিংসতা প্রতিরোধে দাঁড়াতে পারত তবে এমন অবস্থা হতো না।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি কোনো রাখঢাক না করেই বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। অন্য নেতা-কর্মীদের সঙ্গে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের যোগাযোগ সখ্য থাকতেই পারে। আমার সঙ্গেই তো আছে। আমি এবার প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে তো জামায়াতের সহযোগিতা আমিও নিতাম। কারণ এখানে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থান সব সময়ই শক্ত। স্বাধীনতার পর থেকে আসনগুলো এই দুই দলের মধ্যেই ছিল। বিশেষ করে সুন্দরগঞ্জে বেশির ভাগ সময়ই জামায়াতের এমপি ছিল। মাঝে কয়েকবার আমরা পেয়েছি। তিনি বলেন, ‘মূলত আওয়ামী লীগ-বিরোধী অবস্থানের কারণেই জামায়াত প্রয়োজনমতো বিএনপি বা জাতীয় পার্টির সঙ্গে থাকে।

শেয়ার করুন