বীজের সঠিক চাহিদা নিরুপনের প্রয়োজনীয়তা

0
185
Print Friendly, PDF & Email

বীজের চাহিদা নিরুপন একটি দেশের কৃষি উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয়। অর্থনীতিতে চাহিদার সাথে পন্যের সরবরাহ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চাহিদা বেশী কিন্তু পন্যের সরবরাহ কম হলে যেমন সংকট সৃষ্টি হয় তেমনি চাহিদার তুলনায় পন্যের সরবরাহ বেশী হলেও সমস্যা সৃষ্টি করে। কৃষি পন্যের মধ্যে বীজ অন্যান্য অকৃষিজ পন্য থেকে বৈশিষ্টগতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একে অন্যান্য পন্যের মত অবিক্রিত অবস্থায় দীর্ঘদিন গুদামজাত করে রাখা যায় না।

ফসল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে বীজই একমাত্র জীবন্ত উপকরণ (Living input) যাকে একটি মানব শিশুর সংগে তুলনা করা যায়। পরবর্তী ফসল মৌসুম পর্যন্ত একে লালন-পালন করতে হয়। সাধারনত ফসলভেদে বীজকে সর্বাধিক দু’বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে অন্যথায় সংরক্ষণকাল বৃদ্ধির সাথে সাথে বীজের গুনগতমান (Quality) হ্রাস পেতে থাকে।

সাধারণত প্রত্যেক বছরের মোট ফসলী জমির পরিমান নির্ধারণ করে বীজ হার (Seed Rate) দিয়ে গুন করে ওই বছরের বীজের কৃষিতাত্ত্বিক চাহিদা (Agronomic Requirement) নিরুপন করা হয়। আর যদি এই ফসলী জমির পরিসংখ্যানগত তথ্য সঠিক না হয় তবে বীজের চাহিদা নিরুপনও যে সঠিক হবে না তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (Bangladesh Bureau of Statistics) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (Department of Agricultural Extention) ফসলী জমির বার্ষিক পরিসংখ্যান তৈরী করে থাকে। প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে মাঝেমাঝে তথ্যগত গরমিল লক্ষ্য করা যায় যা বীজের চাহিদা নিরুপনে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

সঠিকভাবে বীজের চাহিদা নিরুপনে ব্যর্থ হলে বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা কৃষককে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয় ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি উৎপাদন হয় ব্যাহত। বীজের কৃষিতাত্ত্বিক চাহিদা নিরুপনের সাথে সাথে বাজারজাতযোগ্য (Marketable) বীজের চাহিদা অবশ্যই নিরুপন করতে হবে। সরকারিভাবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (BADC) এবং প্রায় তিন শতাধিক Seed Company ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (NGO) বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরন, সংরক্ষন, বিপনণ এবং আমদানির সংগে জড়িত। বিএডিসি ছাড়া অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানই বানিজ্যিকভাবে বীজ ব্যবসার সাথে জড়িত। দেখা যায় যে, এ সকল প্রতিষ্ঠানের বীজ অনেক সময় অবিক্রিত (Unsold) থেকে যায়, ফলে তাদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। সাম্প্রতিক দু’এক বছরে বিএডিসিরও কিছু বীজ অবিক্রিত থাকার কারনে অবীজ (Non-Seed) হিসেবে বিক্রয় করতে হয়েছে। আবার অনেক সময় অত্যাধিক চাহিদার কারনে বীজ সরবরাহ করতে না পারায় ওই সকল প্রতিষ্ঠান একদিকে যেমন অধিক লাভ থেকে হয় বঞ্চিত অন্যদিকে পরিমানমত ভাল বীজ না পেয়ে কৃষি উৎপাদন হয় ক্ষতিগ্রস্ত, অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয় ব্যাহত। তাই সঠিকভাবে বীজের চাহিদা নিরুপন অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন একটি বিষয়। তবে এদেশে ভাল বীজের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও বীজ অবিক্রিত থাকা কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। বীজের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও বীজ অবিক্রিত থাকলে কারনগুলো খুঁজে বের করা প্রয়োজন। তবে এটি অনস্বীকার্য যে সরকারের উদার বীজ নীতির কারনে পূর্বের তুলনায় ভাল বীজ সরবরাহ ও ব্যবহারের পরিমান বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।

একদিকে যেমন বিএডিসির মাধ্যমে বীজ সরবরাহের পরিমান বৃদ্ধি করা হয়েছে অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বীজ কোম্পানী অনুমোদনের মাধ্যমে বীজ সরবরাহের পরিমান কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি মন্ত্রনালয়ের ২০১২-১৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, দেশে আউশ, আমন ও বোরো ধানের জমির পরিমান যথাক্রমে ৯.০, ৪০.১৫ এবং ৪৭.৩৫ লক্ষ হেক্টর এবং একই জমির বিপরীতে উক্ত ধান বীজের কৃষিতাত্ত্বিক চাহিদা যথাক্রমে ০.২২, ১.০৫ এবং ১.১৩ লক্ষ মে. টন, সে হিসেবে বিএডিসি ২০১২-১৩ সালের মোট আউশ ধান বীজের চাহিদার ১১.৫% (২৫৯৬ মে.টন), আমন ধান বীজের ২১.৬%(২১৬৭১মে.টন) ও বোরো ধান বীজের ৬৬.৯% (৬০৮৫২ মে.টন) সরবরাহ করেছে। উক্ত প্রতিবেদন থেকে এও জানা যায় যে, বিএডিসি বীজের মোট চাহিদার ৩৩.৫% গম বীজ, ৩.৪% আলু বীজ, ২.২% ভূট্টা বীজ, ১৫.৪% ডাল ও তৈল বীজ, ১৭.৮% পাট বীজ, ৪.৪% সবজি বীজ ও ০.১% মসলাজাতীয় বীজ সরবরাহ করেছে। ২০১১ সালে ”সার্ক কৃষি কেন্দ্র” থেকে প্রকাশিত Quality Seed in SAARC Countries শীর্ষক পুস্তক থেকে জানা যায় যে, বর্তমানে দেশের মোট বীজের চাহিদার ১৮% সরকারি ও বেসরকারি প্রাতিষ্ঠান কর্তৃক পুরণ করা হচ্ছে এবং বাকী ৮২% পুরণ করা হচ্ছে কৃষকের বাড়িতে সংরক্ষিত বীজ থেকে যা গুনগতমানসম্পন্ন নয়। কৃষকের বাড়িতে সংরক্ষিত এ বীজের পরিমান কতটুকু তথ্যভিত্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় ক্রমান্বয়ে আবাদি জমি ১.০% হারে কমে যাচ্ছে, এ তথ্য সঠিক হলে বীজের কৃষিতাত্ত্বিক চাহিদা তো কম হওয়ার কথা, সে হিসেবে কৃষকের সংরক্ষিত বীজের পরিমান কমে যাবে এবং আনুপাতিকহারে প্রাতিষ্ঠানিক বীজের পরিমান অবশ্যই বেড়ে যাবে, কারন আবাদি জমি, সরবরাহকৃত প্রতিষ্ঠানিক বীজ ও কৃষকের সংরক্ষিত বীজ এর পরিমান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা বীজ কোম্পানী কর্তৃক উৎপাদিত এবং বাজারজাতকৃত বীজের তথ্য-উপাত্ত (Data) নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। ব্যবসায়িক নীতির কারণে হয়ত তারা সঠিক তথ্য প্রকাশে অনিচ্ছুক। সাম্প্রতিককালে এলাকা বিশেষ ফসলের চাষ পদ্ধতিতে (Cropping Pattern) কিছুটা পরিবর্তন আসায় নিট ফসলী জমির (Net Cropped Area) পরিমান হ্রাস পেলেও মোট ফসলি জমির (Total Cropped Area) পরিমান হ্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিবিএস ২০১০ অনুযায়ী ২০০৬-০৭, ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ সালে নিট ফসলী জমির পরিমান যথাক্রমে ৭৮.০, ৭৭.৬৮ এবং ৭৯.৪৩ লক্ষ হেক্টর হলেও একই বছরে মোট ফসলি জমির পরিমান যথাক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩৭.৩৪, ১৩৮.৭৮ ও ১৪৪.১৯ লক্ষ হেক্টরে এবং বিবিএস ২০১২ অনুযায়ী দেশের মোট ফসলি জমির পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িয়েছে ১৪৯.৫০ লক্ষ হেক্টরে। উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কৃষি জমি হ্রাসের পরিমান মাত্র ০.২৪%, ওই প্রতিবেদনে এও উল্লেখ আছে যে, ১.০% হারে কৃষি জমি হ্রাসের বহুল প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয় (NFPCSP/FAO Research Report, ঢাকা-২০১৩)।

এমতাবস্থায় বীজের প্রকৃত চাহিদা নিরুপন অত্যন্ত জরুরী হয়ে পরেছে। এ চাহিদা নিরুপন হতে হবে দীর্ঘমেয়াদী (Long Term) ও স্বল্পমেয়াদী (Short Term) সময়ের জন্য। স্বল্পমেয়াদী সময়ের জন্য বীজের সরবরাহের নিশ্চিয়তা বিধানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীকে সাধারনত এক বছর পূর্বে বীজের চাহিদার পূর্বাভাষ করতে (Demand Forecast) হবে। চাহিদার পূর্বাভাষ এর ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীকে বীজ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে। এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলি (Factors) হচ্ছে আবহাওয়াগত পরিবর্তন, কৃষিপন্যের বাজারদর, পূর্ববর্তী বছরে ফসলের ফলন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যান্য কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা, কৃষকের সচ্ছলতা, বীজের প্রতিস্থাপন হার (Seed Replacement Rate) ইত্যাদি। বছরওয়ারী বীজ উৎপাদন, সরবরাহ ও আমদানীর ক্ষেত্রে বীজ উৎপাদনকারী ও বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কৃষি মন্ত্রনালয়ের বীজ উইং বীজ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নিতে পারে।

শেয়ার করুন