নজিরবিহীন সহিংসতার মধ্য বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ‘প্রাণঘাতী’ এই নির্বাচনে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে আওয়ামী লীগ।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (বিদেশ মন্ত্রক)’র অনুমান, এই নির্বাচনের পরে সরকার গড়া মাত্রই পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ এবং সংগঠন প্রবল চাপ দেবে হাসিনা সরকারের উপর। সরকারকে অগণতান্ত্রিক অ্যাখ্যা দিয়ে ঢাকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করাটাও অস্বাভাবিক নয়। এই প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ প্রতিহত করার জন্য মুজিব-কন্যার পাশেই থাকতে চাইছে নয়াদিল্লি।
ফলে বাংলাদেশের নতুন এই সরকারকে আপাতত স্থিতিশীল রাখতে কূটনৈতিক লড়াইয়ের প্রক্রিয়া সোমবার থেকেই বাড়াচ্ছে দিল্লি। আমেরিকার সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি কমনওয়েলথ এর মঞ্চকে কাজে লাগিয়েও হাসিনা সরকারের সমর্থনে স্বর তুলতে চায় ভারত। এই মুহূর্তে ‘কমনওয়েলথ মিনিস্টারিয়াল অ্যাকশন গ্রুপ’-এর সদস্য ভারত। বর্তমান নির্বাচনকে অগণতান্ত্রিক অ্যাখ্যা দিয়ে কমনওয়েলথভুক্ত কোনও দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর্থিক বা অন্য কোনও নিষেধাজ্ঞা জারির চেষ্টা করলে হস্তক্ষেপ করবে দিল্লি।
ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা এ কথা জানায়।
সোমবার অনলাইন সংস্করণে পত্রিকাটি আরো জানায়, ভোট ঘোষণা হওয়ার সময় থেকেই আমেরিকার সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিরোধ চালিয়ে এসেছে নয়াদিল্লি। কিন্তু জামায়াতে ইসলামিকে মূল ¯্রােতে প্রতিষ্ঠার পক্ষেই আলোচনা করে গিয়েছে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। নিরপেক্ষতার বদলে বিএনপি-ঘেঁষা অবস্থানই বরাবর নিয়ে এসেছে তারা। ভারতের পাল্টা যুক্তি, যাবতীয় জঙ্গি কার্যকলাপের মাথা কট্টর মৌলবাদী এই জামায়াতকে সমাজের সর্বস্তরে ডালপালা ছাড়ানোর সুযোগ দিলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধ্বংস হবে। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বড় প্রশ্নের মুখে পড়বে। এমনিতেই এ বছর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেই আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে রয়েছে পুরো অঞ্চল। তার উপর বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র ইসলামিক উগ্রপন্থার হাতে চলে গেলে পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে এটাই পশ্চিমা বিশ্বকে বোঝাতে চাইছে নয়াদিল্লি। দ্বিপাক্ষিক ক্ষেত্রে সাউথ ব্লকের আশঙ্কা, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে শুধু হিন্দুই নয়, সে দেশ থেকে ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ঢল নামবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দিকে।
আওয়ামী লীগের সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যে যথেষ্ট এগিয়েছে এ কথা সরাসরি স্বীকার করেছে বিদেশ মন্ত্রক। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মাটিতে ভারত-বিরোধী জঙ্গি পরিকাঠামো ধ্বংস করা সব কিছুতেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে হাসিনা সরকার। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ প্রতিশ্রুতি দিলেও ঘরোয়া ঐকমত্যের অভাবে তিস্তা চুক্তি অথবা স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারত সম্পন্ন করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু নানা ভাবে হাসিনার পাশে থেকেছে। সেই অবস্থান হাসিনা সরকারের পরের মেয়াদের জন্যও জারি রাখতে চায় দিল্লি।
কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য কোমর বেঁধে দাঁড়ানোর প্রশ্নে একটা বড় সমস্যাও রয়েছে বলে মনে করছেন কূটনীতিবিদরা। কেননা ভারত নিজেই লোকসভা নির্বাচনের দোর গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। লোকসভার পর প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নেবেন বলে দু’দিন আগেই ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সব দলই এখন ব্যস্ত নির্বাচনী রণকৌশল নিয়ে। ফলে বিদেশনীতির প্রশ্নে একাট্টা হওয়া যেমন দেশের রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে কষ্টকর তেমনই এই মুহূর্তে দেশের কোনও কূটনৈতিক লড়াইও রাজনৈতিক শক্তির অভাবে তেমন জোর পাওয়া কঠিন।
তবে এই এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যতটা সম্ভব প্রয়াস চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কূটনীতিকরা। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, হাসিনা সরকারের নেতাদের মতো সাউথ ব্লকও একটি কথা জোরের সঙ্গে বিশ্বাস করে। তা হল তা-বের আবহে সমাপ্ত হওয়া এবারের নির্বাচনের মুখ্য বিষয়টি নিছকই ব্যালট-যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে ধর্মভিত্তিক ইসলামিক রাষ্ট্রগঠনের লড়াই। নির্বাচনের পরেও এই লড়াই চলবে বলেই মনে করছে ভারত।