নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহতের ঘোষণা আগেই দিয়েছিল বিএনপিসহ ১৮ দল৷ কার্যত নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন প্রতিহতে মাঠে নামে তারা৷ তবে তাদের ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল সরকারও৷ কিন্তু তারপরও প্রাণহানি থামানো যায়নি৷
গত বছরের ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন থেকে শনিবার পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় জোট ছয় দফায় ২৬ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে৷ এই সময় সারা দেশে প্রাণ হারিয়েছেন ১২৩ জন৷ আর রোবেবার নির্বাচনের দিন বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে৷ এতে নিহত কমপক্ষে ১৮ জন৷ সব মিলিয়ে এই নির্বাচনের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে কমপক্ষে ১৪১ জনকে৷
এত প্রাণহানি আগে ঘটেনি
১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শুরুর পর রবিবার পর্যন্ত ছয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ তবে এবারের মতো এতো প্রাণহানির ঘটনা এর আগে আর কোনো নির্বাচনে ঘটেনি৷ ১৯৯৬ সালে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করে বিএনপি৷ ওই বছর নির্বাচন ঘিরে প্রাণ হারান ৪১ জন৷ আর ২০০১ সালের নির্বাচন ঘিরে নিহত হয়েছিল ৩৮ জন৷ সবশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে কোনো ধরনের সহিংসতাই হয়নি৷ কোনো প্রাণহানির খবরও পাওয়া যায়নি৷ এই নির্বাচনটি সেনা সমর্থিত সরকারের অধীনে হয়েছে৷
নির্বাচনে এত প্রাণহানির পরও পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, “কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ৷” তাহলে এত প্রাণহানি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সবকিছু নির্বাচনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে হবে না৷ শুধু নির্বাচন নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এর জন্যও একটি মহল সন্ত্রাস করছে৷ এতেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটছে৷” তবে সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে বলে দাবি করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক৷
সর্বোচ্চ প্রাণহানি গত বছর
নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার পাশাপাশি গেল বছর রাজনৈতিক সহিংসতায় সর্বোচ্চসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে৷ মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, গেল বছর জুড়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় এবং বছরের শেষদিকে একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ও বিরোধী জোটের অবরোধ কর্মসূচির মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সারা বছরে ৫০৭ জন মারা গেছেন৷ আর আহত হয়েছেন ২২ হাজার ৪০৭ জন৷
তবে প্রাণহানি নতুন নয়
২০০১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও তার আগে সহিংসতার ঘটনা ঘটে৷ ওই বছরের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগের এক সপ্তাহে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় ৩৮ জন প্রাণ হারান, আহত হন কমপক্ষে এক হাজার ৬৭২ জন৷ নির্বাচনি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, পেশিশক্তি প্রদর্শনসহ নানা করলে এই সহিংসতার ঘটনা ঘটে৷ এছাড়া ওই বছরজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতাও ছিল অনেক৷
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে বিএনপি৷ ওই বছরের ৭ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত ২১ দিন হরতাল করেছে আওয়ামী লীগ৷ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ৮ ও ৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকলেও তা উপেক্ষা করেই মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার কাজ শেষ করে বিএনপি৷ এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ও নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ৷ তারপরও নির্বাচন করে বিএনপি৷ এরপর শুরু হয় অসহযোগ৷ টানা অসহযোগের পর ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ খালেদা জিয়া সংসদে নির্দলীয় সরকারের বিল পাসের পর অসহযোগ আন্দোলন শেষ হয়৷ টানা এ আন্দোলন চললেও ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক সহিংসতা এত ভয়াবহ ছিল না৷ ওই এক বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা যান ৪৯ জন৷ এর মধ্যে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় মারা গেছেন মোট ৪১ জন৷
‘নির্বাচনের আগে প্রাণহানি ঘটে’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, “দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটে৷ কিন্তু এটা খুব স্পষ্ট যে এবারের নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া বানচালের জন্য জামায়াত-শিবির উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সারা দেশে বোমাবাজি ও পরিকল্পিত হত্যার মতো সহিংসতার ঘটনা ঘটাচ্ছে৷ এর সবকিছুকে রাজনৈতিক সহিংসতা বললে ঠিক বলা হবে না৷ তবে নির্বাচনের দিন এত বেশি প্রাণহানি অবশ্যই আমাদের উদ্বিগ্ন করে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আরো বেশি সতর্ক হওয়া উচিত ছিল৷ তাতে প্রাণহানি অনেক কমানো যেত৷ সূত্র: ডিডব্লিউ