জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে বিনা ভোটেই জিতে গেছেন মহাজোটের প্রার্থীরা। ফলে ভোটারদের প্রায় ৫৩ ভাগই ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাননি। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টিসহ দেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বাচনকে করেছে প্রত্যাখ্যান। নিরাপদে ভোট দেয়ার জন্য নেই একটিও ঝুঁকিমুক্ত কেন্দ্র। নির্বাচন নিয়ে অধিকাংশ ভোটারের মধ্যে কোনো আগ্রহও নেই; নেই বিদেশি পর্যবেক্ষকও। ছিল না নির্বাচনী প্রচারণা। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা মাত্র চার দিন গোটা পাঁচেক জেলায় বক্তৃতায় দিয়েই প্রচারণা সাঙ্গ করেছেন।
এরকম একটি পরিস্থিতিতে আজ রোববার অনুষ্ঠিত হচ্ছে দশম সংসদ নির্বাচন।
রাজনৈতিক দল, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক ও বিশ্ব গণমাধ্যম একে প্রহসনের নির্বাচন বলে মন্তব্য করেছে। আওয়ামী লীগ সমর্থক ঢাকা ট্রিবিউনের জরিপ বলছে, দেশের ৭৭ ভাগ ভোটার এ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতন্ত্রের ইতিহাসে এ নির্বাচন কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। একতরফা নির্বাচনের ইতিহাসে এটি হবে নিকৃষ্টতম উদাহরণ।
প্রহসনের এ নির্বাচন রুখতে এককাতারে শামিল হয়েছেন বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা সমস্বরে এই নির্বাচনকে প্রতিহত করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
কলঙ্কিত এই নির্বাচন রুখতে শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক গণপ্রতিরোধ।
দেশের প্রায় অন্তত প্রায় অর্ধশত জেলার দুই শতাধিক ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল-বোমা হামলা চালিয়েছেন ক্ষুব্ধ জনতা। অন্যদিকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় তিনটি কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জাম নেয়ার সময় পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনী সরঞ্জাম ছিনিয়ে নিয়ে আগুন দিয়েছে স্থানীয় জনতা। এ সময় জনতার হামলায় ৩ পুলিশ আহত হয়েছে।
১৮ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে প্রহসনের এই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের আহ্বান জানানো হয়েছে। বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বন্দুকের শাসনের মুখেও ৫ জানুয়ারির নির্লজ্জ প্রহসনের কলঙ্কময় ও জালিয়াতির নির্বাচন প্রতিহত করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান কারও নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বাচন প্রতিহতের আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচনে প্রতিহতের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এরশাদের উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজ লন্ডন থেকে এক ভিডিও বার্তায় জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পক্ষে নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। বিকল্প ধারার সভাপতি ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমদ ভোটদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও নির্বাচন স্থগিত করার জন্য দফায় দফায় সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় গত ২৫ অক্টোবর থেকে কমপক্ষে ১৬০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৫ হাজারের বেশি মানুষ। যৌথবাহিনী ও র্যাব-পুলিশের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণে।ডর শিকার হয়েছেন ৬২ জন। বিরোধী দলীয় বহু নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণের সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ।
আজ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এর ফলাফল আগেই জানা হয়ে গেছে। আজ ভোট হবে বাকি ১৪৭টি আসনে। এতে মোট ভোটার ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। প্রার্থী মাত্র ৩৯০ জন। এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও নামস্বর্বস্ব ১১টি দল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১২০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ২৭টি আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী দেয়া হয়নি। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ৬৬, জাতীয় পার্টি (জেপি) ২৭, জাসদ ২১ ও ওয়ার্কার্স পার্টি ১৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। অন্যান্য দলের প্রার্থীসংখ্যা এক অংকের ঘরে। রোববারের নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ১৮ হাজার ২০৯ ও ভোটকক্ষ ৯১ হাজার ২১৩টি। এরমধ্যে একটি কেন্দ্রও ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে ঘোষণা দিতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।
দেশীয় ২২টি সংগঠনের ১০ হাজার স্থানীয় পর্যবেক্ষক এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে বলে জানিয়েছে ইসি। এগুলো মূলত আওয়ামী লীগের পকেট সংগঠন। বিদেশি পর্যবেক্ষক রয়েছেন মাত্র চারজন। এরা এসেছেন আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষক ভারত ও তার অধীনস্ত রাষ্ট্র ভুটান থেকে।
তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে দেশি ও বিদেশি মিলিয়ে পর্যবেক্ষক ছিলেন এক লাখ ৬০ হাজার। বিদেশি পর্যবেক্ষক ছিলেন ৫৮৫ জন। বিরোধী দলহীন নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো আসেনি। আগের সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যক পর্যবেক্ষক পাঠালেও এবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, গণচীন, জাপানসহ বিদেশি কোনো সংস্থা বা রাষ্ট্র এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে না বলে ইসিকে জানিয়ে দিয়েছে।
জাতীয় সংসদের বিগত ৯টি নির্বাচনের তুলনায় সবদিক থেকেই কলঙ্কের রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে আজকের নির্বাচন। প্রার্থীর দিক থেকে সবচেয়ে কম, বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রেকর্ড, বিদেশি পর্যবেক্ষক না আসা এবং কমসংখ্যক দলের অংশগ্রহণ।
অকল্পনীয় গণপ্রতিরোধের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পৌনে চার লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশ ও আর্মড পুলিশ মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত থাকবে। রয়েছে মোবাইল কোর্ট। নির্বাচনে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর ৫০ হাজারের বেশি সদস্য মাঠে রয়েছে। এছাড়া ১৬ হাজার ১৮১ বিজিবি, র্যাব ৮ হাজার, পুলিশ ৮০ হাজার, আনসার ২ লাখ ২০ হাজার ও উপকূলীয় এলাকায় কোস্টগার্ডের দুই শতাধিক সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
নির্বাচন পরিচালনা খাতে ৬৭ কোটি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা খাতে ১৪৭ কোটিসহ মোট ২১৪ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ৫৪ কোটি, পুলিশ-র্যাব ৪৩ কোটি, আনসার ৪৪ কোটি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১ লাখ, কোস্টগার্ড সোয়া ৮ লাখ ও বিজিবির জন্য ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে মোট ১৬৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। এবার ১৪৭ আসনে ব্যয় হচ্ছে ২১৪ কোটি টাকা।
রূপগঞ্জে একযোগে ৬০ কেন্দ্রে বোমা হামলা
রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় একযোগে ৬০ কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে ভোটার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। কাঞ্চন পৌর বাজার ও চরপাড়া কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণে ৩ জন আহত হয়। আহত জুয়েল, রাজিব ও মনিরকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশের গ্রেফতার অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।
রূপগঞ্জ থানার ওসি আসাদুজ্জামান মীর জানান, দুর্বৃত্তরা নির্বাচন বানচালের জন্যই স্থানে স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভোটারদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে। দুর্বৃত্তদের গ্রেফতারে র্যাব, পুলিশ ও যৌথবাহিনী তত্পর রয়েছে।
এদিকে শনিবার ভোরে বানিয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাড়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তারাব পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট, আউখাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভুলতা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের হাটাবো কার্যালয়ে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে বড় ধরণের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে পুলিশ দাবি করেন।
যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা মুস্তাফিজুর রহমান ভুঁইয়া দিপু জানান, যে কোনো মূল্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জনসাধারণকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আহবান জানান।
উপজেলা রিটার্নিং অফিসার ও নির্বাহী কর্মকর্তা আবু জাফর রাশেদ জানান, কেন্দ্রে আগুন দিয়ে ও ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নির্বাচন বানচাল করতে পারবে না। সুষ্ঠুভাবেই সব কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।