বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটে কূটনৈতিক তৎপরতায় অন্যান্য দেশের মতো চীনের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ছে না। ভূরাজনৈতিক অগ্রাধিকার বিবেচনায় বাংলাদেশের রাজনীতির চাইতে এখন তারা আঞ্চলিক রাজনীতি ও সমরনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। ঠিক এ কারণে এখানকার সাময়িক রাজনৈতিক অস্থিরতায় নাক না গলালেও গুরুত্বসহকারেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলে বিশ্লেষকদের মত। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি নিয়ে যারা খোঁজখবর রাখেন তারা মনে করছেন, এশিয়া- প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি এ অঞ্চলে যে নতুন করে শক্তির প্রতিযোগিতা উসকে দিয়েছে তাতে বাড়ির পাশের প্রতিযোগী হিসেবে ভারতকেই বিবেচনা করছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমুদ্রে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশমুখ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। আর পয়েন্টটি দখলে রাখতেই ভারত-চীন দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে।
আর এ কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যেকোনো সামরিক সম্পর্ক এখন ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়টিই দুই সমর বিশ্লেষকের কথায় উঠে এসেছে।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের ব্লগে বিশ্লেষণটি লিখেছেন বাংলাদেশভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া গবেষক আরাফাত কবির এবং জাপানের প্যাসিফিক ফোরাম সিএসআইএস এর ফেলো জে বার্কশায়ার মিলার।
বেইজিং দিল্লির সঙ্গে কিছু কৌশলগত ক্ষেত্রে সমঝোতা রক্ষার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে কোনো একটি প্রতিক্রিয়া শিগগিরিই দেখা যেতে পারে। ঢাকার সামরিক শক্তি বাড়াতে চীন একাধিকবার সাবমেরিন বিক্রি করতে সম্মত হয়েছে। গতমাসেই চীন এবং বাংলাদেশ ২০ কোটি ৩০ লাখ ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সে চুক্তি অনুসারে, দু’টি মিং শ্রেণীর সাবমেরিন চীনের কাছ থেকে কিনবে বাংলাদেশ।
দেশ দু’টির ক্রমশ ঘনিষ্ট হয়ে ওঠা সামরিক সম্পর্ক দেখে ভারত তার অসন্তোষ চেপে রাখতে পারেনি। এরই মাঝে দেশটির কূটনীতিকদের একজন বেইজিংকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে এমন একটি চুক্তিতে যাওয়ার এখনই কোনো প্রয়োজন ছিল কি না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দিল্লির শঙ্কার জায়গাটি আসলে তাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে: তাদের সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশের সাবমেরিন গোপনে প্রবেশ করবে কি না, তা নিয়ে তারা চিন্তিত।
ভারত তাদের এমন আশঙ্কার সূত্র ধরে বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় তাদের নৌসেনার সংখ্যা বাড়িয়ে সতর্কতা অবলম্বনের পরিকল্পনা করছে। ভারতীয় নৌবাহিনী এরই মধ্যে চীন-বাংলাদেশ চুক্তির বিপরীতে কিছু পাল্টা কর্মপন্থা অবলম্বন করেছে। প্রথমত তারা বাংলাদেশের উপকূল ঘেঁষে তাদের ‘সাগর’ দ্বীপে মিসাইল ব্যাটারি স্থাপন করতে যাচ্ছে। এবং একই স্থানে বিপুল সামরিক নৌযানের সমাবেশ ঘটানোর মতো গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের সব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেইসাথে সাগর দ্বীপে এমন নৌঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে যেখান থেকে ভূমি থেকে নৌযানে এবং ভূমি থেকে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে সক্ষম হবে। বঙ্গোপসাগরে শক্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করে প্রভাব বাড়ানোর জন্য ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এরই মাঝে অকল্পনীয় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে।
ভারতের এতোখানি উদ্বেগের কারণ চীন। যেখানে চীন কোনো প্রতিরক্ষামূলক সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেখানে তা বড় ধরনের হুমকির কারণ বলেই মনে করে ভারত। এমনকি ক্রমশ তাদের প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে যেতে থাকা বাংলাদেশের চেয়েও তা অধিক উদ্বেগের কারণ ভারতের কাছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল ওয়ার কলেজের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের অধ্যাপক পল জে স্মিথও ভারতের এমন উদ্বেগের পেছনে চীনের উপস্থিতিকেই মনে করছেন। তিনি বলেছেন, ‘চীন তার প্রভাববলয় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত করবে। এমনকি চট্টগ্রামকে আরেকটি ‘গাদার ইস্ট’ বানাতে পারে কি না ভারত এই ভয় করছে।’ গাদার ইস্ট একটি পাকিস্তানি কৌশলগত নৌবন্দর যা আরব সাগর এবং পারস্য উপসাগরে প্রবেশের ঘাঁটি এবং বর্তমানে চীনের আগ্রহের অন্যতম বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই বন্দর বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখানে চীনের বিনিয়োগ এবং নিয়ন্ত্রণকে পাকিস্তান স্বাগত জানানোর কারণে বন্দরটি ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফলশ্রুতিতে সেদিক থেকেও চীন ভারতের উদ্বেগের কারণ হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
কিন্তু এ দিক থেকে ঢাকার সত্যিকার মনোভাবও বুঝতে হবে দিল্লিকে। কারণ এখনও এমন মনে হওয়ার কারণ নেই যে, বাংলাদেশ তাদের সমুদ্রসীমায় চীনের অবাধ প্রবেশের সুযোগ করে দিতে প্রস্তুত। কারণ, বাংলাদেশ এটিও জানে, ভারতের সঙ্গে নৌশক্তিতে পেরে ওঠার অবস্থান থেকে তারা এখনও অনেক দূরে। উপরন্তু বাংলাদেশ ভাবতে পারে বরং মিয়ানমারের কথা, যাদের সঙ্গে সমুদ্রসীমা এবং জাতিবিদ্বেষকেন্দ্রিক বিবাদ (রোহিঙ্গা-রাখাইন) মাঝেমাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এ প্রসঙ্গে মনে করা যায় ২০০৮ সালের কথা, যখন বাংলাদেশ মিয়ানমারের একটি খনিজসন্ধানী জাহাজের দিকে একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে একরকম যুদ্ধংদেহী অবস্থান নিয়েছিল, কেননা সেই খনিজসন্ধানী জাহাজটিকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিল মিয়ানমারের কিছু সামরিক নৌযান।
বাংলাদেশের নৌশক্তি বৃদ্ধির প্রবণতা দেখে ভারত নিঃসন্দেহে ঢাকার প্রকৃত অভিপ্রায় অনুমান করছে। উদাহরণস্বরূপ, চীনকে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের অনুমতি দিবে এমনটি ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। আর বাংলাদেশ এটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে যে, তারা সাগর সমরে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়া তো দূরের কথা তার সমকক্ষও হতে পারবে না। তার চেয়ে বরং বাংলাদেশের দৃষ্টি মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের দিকে নিবদ্ধ। ২০০৮ সালে এ উত্তেজনা অত্যন্ত বেড়ে যায় যখন মিয়ানমারের একটি খনিজতেল অনুসন্ধানী জাহাজকে প্রতিহত করতে বাংলাদেশ ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। ইস্যুটিকে পরে জাতিসংঘের সমুদ্র আইনের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (আইটিএলওএস) সমাধানের জন্য নিয়ে যায় বাংলাদেশ। ২০১২ তে বাংলাদেশের পক্ষে আদালতের রায় আসার অনেক আগেই বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছে। যেমন: বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রথমবারের মতো স্বয়ংক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। এছাড়া ছোট আকারের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনও শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হ্যামিলটন শ্রেণীর ইউএসসিজি কাটার জারভিস যা বাংলাদেশের সমরাস্ত্র বহরে সবচেয়ে বড় সামরিক নৌযান।
মজার ব্যাপার হলো, এ জাহাজটির নাম রাখা হয়েছে ‘সমুদ্র জয়’ যা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জলসীমা বিরোধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিজয়ের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
দৃশ্যত, পূর্বাঞ্চলে মিয়ানমারের দিক থেকেই বাংলাদেশ বেশি হুমকি অনুভব করছে। সে অনুপাতে তারা ভারতকে ততোটা হুমকি মনে করছে না।
স্মিথের মতে, ঢাকার অভিপ্রায় অনেক নমনীয় মনে হলেও চীনের সঙ্গে তাদের চুক্তির বিষয়টি ব্যাপক অর্থে ভূরাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাষায়: ‘আমি বিশ্বাস করি না এই সাবমেরিন ভারতের জন্য কোনো হুমকি হবে। কিন্তু এ অঞ্চলে যে বড় একটা খেলা চলছে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাবে। ভারতসাগর একুশ শতকের কৌশলগত ময়দান। চীন ভারত সাগরকে ভূরাজনীতিতে তার উত্থানের চাবি মনে করছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলের সমুদ্রপথ যখন চীনের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উৎস মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার জ্বালানি পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত।’ আর এই বৃহৎ কৌশলগত খেলাটি দীর্ঘ মেয়াদে আরো বড় সমস্যা হয়ে আবির্ভূত হবে।
স্মিথ আরেকটু এগিয়ে বলেন, সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ এশিয়ায় যেসব বিষয় মারাত্মক অর্থ বহন করে তার মধ্যে একটি হলো চীন ও ভারত দ্বন্দ্ব। পাকিস্তান এবং বর্ধিত বলয়ে বাংলাদেশ শুধু বেইজিংয়ের হয়ে প্রক্সি দিচ্ছে মাত্র। এ বিষয়টা ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে যখন তার দুই প্রতিবেশী সামরিক শক্তি বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
ভূগোল অবশ্য চীনকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের অনুমতি দেয় না। কিন্তু জাতীয় সীমানার বাইরে নৌশক্তি বৃদ্ধির পথে চীনের জন্য এটা কোনো বাধা নয়। চীনের আন্তর্জাতিক নৌশক্তি বিস্তারে বাংলাদেশ হলো একটি উপাদান। অধ্যাপক স্মিথ বলেন, ‘বাংলাদেশের কাছে চীনের সাবমেরিন বিক্রি এ কারণেই উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। ভাবুন আপনি ভারতের একজন সামরিক নীতিনির্ধারক, আপনার পশ্চিম সীমান্তে রয়েছে চীন (পাকিস্তান প্রক্সি) এবং পূর্ব সীমান্তে চীনা প্রভাব বাড়ছে যেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক বাড়ছে।’
চীন এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, সিসিলি এবং মরিশাসের সঙ্গে কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক জোরদার করছে। ভারত মহাসাগরে এটা একটা নতুন মহাযজ্ঞ। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়াপ্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বাড়াচ্ছে সেখানে চীন ভারতসাগর কবজায় নেয়ার চেষ্টা করছে।
সুতরাং বাংলাদেশ হচ্ছে সেই মহাক্রীড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।