৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন সফল করতে গিয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রাষ্ট্রপতির অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চার কমিশনার নিয়োগ পান। কিন্তু নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এখন মনে করেন, অনুসন্ধান কমিটি ছিল লোক দেখানো। বাস্তবে দলীয় বিবেচনাতেই কমিশন গঠন করা হয়েছে।
বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়। সব মিলিয়ে পাঁচ হাজারের বেশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন হয়; যাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিএনপির অনুসারীরা জয়ী হন। কমিশন সচিবালয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা মনে করেন, বর্তমান কমিশনকে ‘নিরপেক্ষ’ প্রমাণের জন্যই সরকার স্থানীয় নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করেনি। সরকার যেন ‘সব হস্তক্ষেপ’ জমা রেখেছিল সংসদ নির্বাচনের জন্য। আর কমিশনও সরকারকে এ ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা করে চলেছে।
অনিয়মই নিয়ম: বিরোধী দলবিহীন এই নির্বাচনে সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মকে নিয়ম হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। তারা কোনো আইন পর্যালোচনা না করেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ‘লাঙ্গল’ প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের ‘বেআইনি’ চিঠিকেও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছে কমিশন। গত ১৩ ডিসেম্বর ছিল প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। ১৪ ডিসেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করা কথা। কিন্তু কমিশন ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কিছু আসনের প্রার্থীর তালিকা বারবার রদবদল করেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টি, জেপি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্য শরিকদের সমঝোতা রক্ষা করতে গিয়ে তারা এই অনিয়ম করে।
বিভিন্ন জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তারা ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ ডিসেম্বরের তারিখ দিয়ে অবৈধভাবে প্রার্থীদের কারও মনোনয়নপত্র বাতিল, আবার কারও মনোনয়নপত্র বৈধ দেখিয়েছেন। বরিশাল, পটুয়াখালী, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুর, কক্সবাজার, বগুড়া, লালমনিরহাট, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সিলেট, নীলফামারীসহ আরও কয়েকটি জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তারা এসব অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু কর্তব্যে অবহেলাকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকলেও কমিশন তা নেয়নি।
অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের নির্দেশে রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনিয়মের আশ্রয় নেন। যে কারণে জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন সাংসদ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জমা দেওয়ার পরও তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের অনুকূলে ‘নৌকা’ প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রেও কমিশন আইন মানেনি। আরপিও অনুযায়ী কেউ নির্বাচনী জোট গঠন করলে তা তফসিল ঘোষণার তিন দিনের মধ্যে কমিশনকে জানাতে হবে। ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিঠির মাধ্যমে জোটবদ্ধ প্রার্থী হিসেবে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও তরীকত ফেডারেশনের প্রার্থীদের নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার জন্য কমিশনকে চিঠি দেন। অথচ এই দলগুলো নিয়ে যে নির্বাচনী জোট হয়েছে, তা ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার তিন দিনের মধ্যে কমিশনকে জানানো হয়নি। আইন না মেনেই কমিশন জোটবদ্ধ প্রার্থীদের নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে।
নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল এক হাজার ১০৭টি। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি সরে পড়ায় অনেক আসনে প্রার্থীসংকট দেখা দেয়। তখন কমিশনের পরামর্শে রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনেক প্রার্থীকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে মনোনয়নপত্র শুদ্ধ করে দেন।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই কমিশনের ওপর সরকারের প্রভাব সুস্পষ্ট। যে কারণে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় পার হওয়ার পরও বৈধ মনোনয়নপত্র অবৈধ হয়েছে, আবার অবৈধ মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে। সরকারের ইচ্ছাতেই অর্ধেকের কম আসনে নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও সেনা মোতায়েন হয়েছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘন: নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার দিন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত প্রচারণা চালানো যায় না। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশনে তাদের উন্নয়নের ফিরিস্তি প্রচার শুরু করে, যা এখনো অব্যাহত আছে। প্রচারণার সময় শুরুর আগেই রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তিসহ বিভিন্ন বিলবোর্ড টাঙানো হয়। কিন্তু কমিশন এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বিএনএফকে নিবন্ধন: আরপিও অনুযায়ী, কোনো দলকে নিবন্ধিত হতে হলে ২২ জেলা ও ১০০ উপজেলায় দলীয় দপ্তরসহ কমিটি থাকতে হবে। এই আইন অনুসরণ না করেই কমিশন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টকে (বিএনএফ) নিবন্ধিত করেছে। দলটি বিএনপির দলীয় লোগোর আদলে নিজেদের লোগো তৈরি করেছিল। বিএনপিকে বিভক্ত ও ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে সরকারের চাপে কমিশন বিএনএফকে নিবন্ধিত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকারের পরামর্শে সেনা মোতায়েন: ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সরকার ২০০৯ সালে আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীর নাম বাদ দেয়। সরকারপক্ষ তখন বলেছিল, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে দূরে রাখাই ভালো। দায়িত্ব নিয়ে বর্তমান কমিশনও একই কথা বলেছিল। কিন্তু বিএনপি যখন জানাল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না, তখনই কমিশনের সুর বদলে যায়।
নির্বাচন একতরফা হবে এবং বিএনপি তা প্রতিরোধ করবে—এ বিষয়টি বুঝতে পেরে কমিশন বলতে শুরু করে, সশস্ত্র বাহিনী ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সরকারও কমিশনের এই মতকে সমর্থন দিয়েছে।
কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সশস্ত্র বাহিনী ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু ২ জানুয়ারি সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন হঠাৎ বলে বসেন, সহিংসতা হলে সেনাবাহিনী ৯ জানুয়ারির পরও থাকবে। কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, নির্বাচনের পর সশস্ত্র বাহিনী থাকবে কি থাকবে না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সরকারের, কমিশনের নয়।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ব্যাপারেও কমিশন সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে। এ জন্য তারা তফসিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার কোনো উদ্যোগই নেয়নি।