দেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। বিরোধী জোটের টানা অবরোধের কারণে শিল্প-কলকারখানাসহ ছোট বড় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ কমে এসেছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানে। এরই মধ্যে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে বেকারত্বের সংখ্যা। গত ফেব্র“য়ারি থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকট হওয়ায় এ সময়ে নতুন কর্মসংস্থান হয়নি, বরং চাকরিচ্যুত হয়েছেন বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। সারা দেশের শিল্প-কারখানাগুলোয় অচলাবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। টানা অবরোধ আর হরতালের কারণে মারাÍক অর্থকষ্টে পড়েছে দেশের শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষ। এরই মধ্যে নির্মাণ, পর্যটন, পোলট্রি, পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও তৈরি পোশাকশিল্প খাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির এসব খাত বিপর্যস্ত হওয়ায় লোকসান এড়াতে কয়েক মাসে অন্তত ৪০ শতাংশ শ্রমিক বিদায় করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, তাদের ব্যবসা এমন একপর্যায়ে নেমে এসেছে, অনেকেরই শ্রমিকের বেতন দেয়ার মতো অবস্থা নেই। এ অবস্থার অবসান না হলে বেশির ভাগ ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তার পক্ষে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামার পরিপ্রেক্ষিতে সেবা ও শিল্পের বিভিন্ন খাতে ১০ লাখেরও বেশি শ্রমিক এরই মধ্যে বেকার হয়ে পড়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি বিনিয়োগ, রেমিটেন্স ও কৃষি খাতের সাম্প্রতিক ঋণাÍক প্রবৃদ্ধি সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি কর্মসংস্থানকে বাধাগ্রস্ত করছে। এর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে উচ্চমাত্রার বেকারত্বের ঝুঁকির দিকে এগোচ্ছে দেশ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে নতুন করে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান হয়তো এরই মধ্যে অপ্রয়োজনীয় লোকবল ছাঁটাই করাও শুরু করেছে। তিনি বলেন, চলমান অস্থিরতায় অর্থনীতি যে ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ মধ্যমেয়াদি সংকটে পড়বে। কারণ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় শুধু শিল্প-কলকারখানাই বন্ধ হবে না, বরং ব্যাংকসহ ঋণদান প্রতিষ্ঠানগুলোও ঋণ প্রদানের সক্ষমতা হারাবে। যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতির ছোট-বড় সব সেক্টরে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে চাকরি হারানোর সংখ্যা খুব বেশি না হলেও খুব অল্প দিনের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে প্রকটভাবে। উৎপাদন না করতে পারলে লোকসানে পড়বে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা। যার ফলে বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমিক ছাঁটাই প্রবণতাও বাড়বে। যার পরিণামে দেখা দিতে পারে ভয়ানক শ্রমিক অসন্তোষ। তিনি বলেন, চাকরি হারানোর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। সমাজে দেখা দেবে অশান্তি। এক্ষেত্রে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টা চরমভাবে ব্যাহত হওয়ারও আশংকা থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের পর্যটনশিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। ভরা এ মৌসুমে দেশের প্রধান পর্যটন স্পট কক্সবাজার, সিলেট মৌলভীবাজার ও পার্বত্য জেলাসহ সারা দেশ পর্যটনশূন্য হয়ে পড়েছে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখের বেশি লোক জড়িত। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দাবি, লোকসান এড়াতে গত তিন মাসে এ খাতে ৩০ শতাংশ জনবল ছাঁটাই করা হয়েছে। ব্যবসায় ধস নামায় কক্সবাজারের চার শতাধিক হোটেলের মধ্যে ১০০টি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মচারীদের বিনা বেতনে ছুটিও দেয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে বিশ্ব আর্থিক মন্দাসহ দেশের কূটনৈতিক দুর্বলতার কারণে বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানিতে ভাটা চলছে। আবার দেশের শ্রমশক্তিতে যুক্ত হওয়া নতুন শ্রমিকদের কর্মসংস্থান তৈরিতেও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারিভাবে অস্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিকারী প্রকল্প ন্যাশনাল সার্ভিসের কার্যক্রমও শেষ হওয়ার পথে। ফলে সামনের দিনগুলোয় বেকারত্ব মোকাবেলাই হয়ে উঠবে বড় চ্যালেঞ্জ। আবার প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেই নিয়োজিত হচ্ছেন বেশির ভাগ শ্রমিক। বিবিএসের হিসাবে, মোট কর্মজীবী মানুষের ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক ও ১২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছেন। জানা গেছে, পরিবহনসহ বিভিন্ন সেক্টরে শুধু নারায়ণগঞ্জেই ৩০ হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এছাড়া সিলেট নগরীর শ্রমহাট হিসেবে পরিচিত আম্বরখানা, মদিনা মার্কেট, কাজলশাহ, বান্দরবাজার ও শিবগঞ্জে ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত শ্রমিকরা কাজের জন্য বসে থাকলেও কাজ পাচ্ছেন না। আগে যেখানে শ্রমিকদের প্রতিদিন মজুরি ছিল ৩০০ টাকা, এখন ২০০ টাকায়ও কাজ জোটাতে পারছেন না তারা। বলা চলে, কর্মহীন হয়ে পড়ার মতো এমন দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা সারা দেশেই বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে রংপুর অঞ্চলে প্রায় দুই লাখ সহায়-সম্বলহীন কর্মজীবী নারী-পুরুষ বেকার হয়ে পড়েছে।
এ দিকে জাতিসংঘের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা আংকটাডের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) গত এক দশকে বাড়লেও সে অনুযায়ী কর্মসংস্থান হয়নি। সংস্থাটির মতে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকলেও এর সুফল আসেনি।
আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী কৃষির উপখাত শস্যে প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোটায়। বেসরকারি বিনিয়োগ ও রেমিটেন্সেও প্রবৃদ্ধি ঋণাÍক হয়ে পড়েছে। এছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। নভেম্বর পর্যন্ত স্থানীয় বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ। অক্টোবর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। ঋণ বিতরণে গতি না থাকায় ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় জমেছে। অন্যদিকে কমে গেছে রেমিটেন্স প্রবাহ। চলতি অর্থবছরের ৫ মাসে রেমিটেন্স কমেছে ৯ শতাংশেরও বেশি। বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহেও দেখা দিয়েছে ধীরগতি। সর্বশেষ হিসাবে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বৈদেশিক সহায়তা ছাড়া আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ২৩ শতাংশ। বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার কারণে বিদেশের শ্রমবাজার এখন সংকুচিত। বিকল্প শ্রমবাজারও সৃষ্টি হচ্ছে না। সম্ভাবনাময় বাজার উপসাগরীয় অঞ্চলে শ্রমিক পাঠানো যাচ্ছে না। আবার সরকারিভাবে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগও কার্যকর হচ্ছে না। গত দুই বছরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাত্র ৪০০ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় পাঠানো গেছে। যার প্রভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে বছরের হিসাবে এই প্রথমবারের মতো রেমিটেন্স প্রবাহ কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেমিটেন্স-সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এর আগের বছরগুলোতে পূর্বের বছরের চেয়ে রেমিটেন্স বেশি এসেছে। এতদিন সে ধারাবাহিকতাই চলে আসছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে সেটা আর ধরে রাখা যায়নি। ২০১২ সালে প্রবাসীরা এক হাজার ৪১৭ কোটি ৬৫ লাখ (১৪ দশমিক ১৮ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন। আর সদ্যসমাপ্ত ২০১৩ সালে পাঠিয়েছেন এক হাজার ৩৮৩ কোটি ৮০ লাখ (১৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন) ডলার। শতকরা হিসাবে এ সময়ে রেমিটেন্স কমেছে ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এ তিন খাতের অবনমনে সার্বিক কার্যক্রমে যে বিচ্যুতি ঘটেছে, তার প্রভাবে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে দুর্বল অবকাঠামো, বিশেষ করে অপর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ, আর্থিক খাতের বিশৃংখলা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এসব খাতের অবদান আরও অবনমনের শংকা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিবিএসের তথ্য মতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিগত এককভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে কৃষি, বনজ ও মৎস্য খাত। তিনটি খাতে সম্মিলিতভাবে নিয়োজিত রয়েছে মোট শ্রমশক্তির ৪৭ শতাংশ। তবে কৃষির অন্যতম শস্য খাতে প্রবৃদ্ধি এখন শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। যদিও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে শস্য খাতে প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। কেননা গত চার বছর শস্যের দাম যে হারে বাড়ছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে তার চেয়েও দ্রুতগতিতে। এ সময়ে উৎপাদন খরচ ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশ বাড়লেও দাম বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। বাড়তি এ উৎপাদন খরচের পুরোটাই কৃষক বহন করলেও দাম বাড়ার সুফলের সিংহভাগই ভোগ করছেন ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগীরা।