প্রসঙ্গটা নিজেই তোলেন গোলাম মাওলা রনি। এক নাগাড়ে বলে চলেন যুদ্ধাপরাধে ফাঁসি হওয়া কাদের মোল্লা প্রসঙ্গে তার মনের কথাগুলো। বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্য।
বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কাদের মোল্লাকে নিরাপরাধ দাবি করে তার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বেশ আবেড়তাড়িত পড়েন গোলাম মাওলা রনি। তার দাবি, কসাই কাদের এবং আব্দুল কাদের মোল্লা এক ব্যক্তি নন। তবে তার এই বক্তব্যের মূল ভিত্তি হিসেবে কাদের মোল্লার মামলার নথির কথাই উল্লেখ করেন তিনি। নিজেও কিছু কিছু বিষয় জানেন বলে দাবি করেন সরকারদলীয় এই এমপি। এছাড়াও তার বক্তব্যগুলো ছিলো স্ববিরোধী।
গোলাম মাওলা রনির সঙ্গে বাংলানিউজ টিমের কথা হয় গত ২৮ ডিসেম্বর শনিবার রাজধানীর তোপখানা রোডে তার নিজস্ব ব্যবসায়িক কার্যালয়ে।
রনি বলেন, মিরপুরের কসাই কাদের সম্পর্কে আমি পড়ালেখা করেছি। সেই পড়ালেখা থেকে আমি সিদ্ধান্তে এসেছি এই আব্দুল কাদের মোল্লা কসাই কাদের নন। এ বিষয়ে আমি যে কারো চ্যালেঞ্জ নিতে রাজি আছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ফরিদপুরের সদরপুরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।
কাদের মোল্লাকে ভিখারির ছেলে পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, রাস্তার ফকির ঘনা মোল্লার ছেলে কাদের মোল্লা লজিং থেকে সারাজীবন পড়ালেখা করেছেন। ১৯৭১ সালেই তিনি প্রথম ঢাকা আসেন। এ বছরের মার্চ মাসেই তিনি গ্রামে চলে যান। সেখানে সম্ভ্রান্ত বাড়িতে তিনি লজিং থাকতেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাদের মোল্লা ভুষির ব্যবসা করতেন।
কাদের মোল্লা সম্পর্কে এসব ঘটনা আপনি কি করে জানলেন বাংলানিউজের এমন প্রশ্নে গোলাম মাওলা রনি বলেন, ট্রাইব্যুনালে মামলার নথি থেকে জেনেছেন। আর কিছু কিছু ঘটনা তিনি নিজেই জানতেন।
ট্রাইব্যুনালের নথিতে কাদের মোল্লা, সাঈদী, গোলাম আযম, নিজামীসহ সকলেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সেই নথিকে আপনি সত্য বলে কেন ধরে নিচ্ছেন? এমন প্রশ্নে রনি বলেন, এটি তদন্ত করে দেখা যেতে পারে।
এই তদন্তের জন্য তিনি নিজেই অর্থায়নে রাজি বলে জানালেন গোলাম মাওলা রনি।
সাংবাদিকরা কাদের মোল্লার সঠিক তথ্য জানতে চাইলে আমি অর্থ ঢালবো, বলেন একজন আবেগতাড়িত গোলাম মাওলা রনি।
কাদের মোল্লা সম্পর্কে এত কিছু জেনেও কেন তার পক্ষে সাফাই সাক্ষি দেননি এমন প্রশ্নের জবাবে রনি বলেন, মানুষের জ্ঞান খুব সীমিত। আমি আমার জ্ঞান গরিমায় সে পর্যন্ত যাইনি। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা আমাদের দলের একটি অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল। এর অংশ হিসেবে কিছু লোককে শুরুতেই গ্রেফতার করা হয়। সেখান থেকে ফেরার আর কোন পথ আমার দলের সরকারের ছিল না। সেই দলের প্রতিনিধি হিসেবে আমি সাফাই সাক্ষি দেওয়ার মত অবস্থানে ছিলাম না।
তাহলে এখন কেনো বলছেন? দলে কোনঠাসা হয়ে পড়ার কারণে কি? বাংলানিউজের এই প্রশ্নে রনি জানান, কাদের মোল্লার একটি অনুরোধ রাখার জন্যই তিনি এত কথা বলছেন।
এ প্রসঙ্গে আবারও তিনি কাদের মোল্লার জেলখানায় ‘উস্তাভাজি’ খাওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে পাঠানো চিরকূটের প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা বলেন।
কাদের মোল্লার প্রতি গোলাম মাওলা রনির সহানুভূতির প্রকাশ ঘটে তার নিজস্ব মালিকানাধীন একটি অনলাইনে ওই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করার আগের রাতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে।
ওই নিবন্ধ প্রসঙ্গে রনি বলেন, জেলে যাওয়ার পর কাদের মোল্লা নিজেই আমাকে কথাগুলো তার ফাঁসি কার্যকর পরে জানাতে অনুরোধ করেছিলেন। ১১ ডিসেম্বর ফাঁসি হয়ে যাবে এমন ভাবনা থেকে ওই রাতেই লেখাটি প্রকাশিত হয়। এরপর ১২ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়।
কাদের মোল্লার ফাঁসি একটি বড় রাজনৈতিক ভুল উল্লেখ করে রনি বলেন, আজকের ভুলের খেসারত সমগ্র জাতি একদিন দেবে। তিনি বলেন, যখন কোন ভুলের প্রতিবাদ করার কেউ না থাকে তখন আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। এ কথা বলতে চোখ ছল ছল করতে থাকে গোলাম মাওলা রনির।
তিনি বলেন, আর এ কারণেই আমি কাদের মোল্লা সম্পর্কে আমার জানা তথ্য সাহস করে বলেছি বা লিখেছি। যা তার পরিবারের কেউ এমন কি জামায়াতের কেউ জেনেও লিখতে পারেনি।
তবে রনি এটাও বলেন, ব্যক্তি কাদের মোল্লার ফাঁসিতে খুশি না হলেও আওয়ামী লীগের দলীয় এমপি হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রথম আসামির রায় কার্যকর হওয়ায় তিনি খুশি।
এভাবেই কাদের মোল্লার বিচারের বিষয়ে স্ববিরোধী বক্তব্য দেন গোলাম মাওলা রনি। কাদের মোল্লার বিচার সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ানোর পেছনে স্রেফ রাজনৈতিক ইচ্ছাকে দায়ী করেন তিনি।
কাদের মোল্লা
কাদের মোল্লা
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনকে বিশ্বের অন্যতম সেরা আইন উল্লেখ করেন তিনি বলেন, এই আইন মেনে যে বিচার হবে সেটাই মেনে নেওয়া উচিত ছিল। তা না করে নিজেদের গণতান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলনের মাধ্যমে কাদের মোল্লার বিচারের রায় পরিবর্তন করা আমাদের বিচারের ইতিহাসে একটা খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকল।
আপনি দাবি করছেন কাদের মোল্লা নিরপরাধী, আবার এও বলছেন ট্রাইব্যুনাল তাকে যতটুকু অপরাধী বলেছে সেটাই ঠিক, আবার বলছেন, সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে তা রাজনৈতিক। কাদের মোল্লা নিরাপরাধ হলে ট্রাইব্যুনালের রায় কোন অর্থে ঠিক হলো? এমন প্রশ্নে কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি গোলাম মাওলা রনি।
এ পর্যায়ে বিষয়টি আরও স্ববিরোধী করে তুলে তিনি বলেন, কাদের মোল্লার ফাঁসিতে দলের মত তিনিও আনন্দিত।
রনি বলেন, আজ পুরো দল আনন্দে উদ্বেলিত। তাই এই রায় নিয়ে বলার কিছু নেই। আজকের বাস্তবতা হল সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জাতি বিরাট জয় অর্জন করেছে। আনন্দে ভেসেছে।
আপনি আগে বললেন, রাজনৈতিক ভুল! এখন বলছেন বিরাট জয় অর্জন হয়েছে। আসলে আপনি কোনটি বলতে চান? বাংলানিউজের এমন প্রশ্নেরও জবাব এড়িয়ে যান গোলাম মাওলা রনি।
তিনি বলেন, আমার লেখা বা বলা ব্যক্তি কাদের মোল্লাকে নিয়ে। আমার এই লেখা তাদের জন্য যারা নির্ভুল, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠন করতে চায়, যারা আগামী ২৫ বছর পরের চিন্তা করে তাদের জন্য। যারা শুধু আজকের চিন্তা করছে তাদের জন্য নয়।
এ পর্যায়ে গণজাগরণ মঞ্চের কড়া সমালোচনা করেন গোলাম মাওলা রনি। তিনি বলেন, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে লাফালাফি করা আমার পোস্ট, পজিশন অ্যালাও করেনা।
যেখানে সময় এবং শ্রম দিয়ে দেশ এবং জাতির কোন উপকার করার সুযোগ হবে না সেখানে যাওয়ার চেয়ে পত্রিকা পড়ে সময় কাটানো অনেক ভালো, বলেন রনি।
তিনি বলেন, আমি শুনেছিলাম শুরু থেকেই সেখানে যেসব সিনিয়র নেতারা গিয়েছিলেন সেখানে বোতল মারা হচ্ছে। তাহলে আমি কেন সেখানে অপাঙক্তেয় হিসেবে সেখানে যাব? আমার মত আন্দালিব রহমান পার্থ সেখানে যাননি। মাহি বি চৌধুরি একদিন গিয়ে আর যাননি।
উল্লেখ্য, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ ছয়টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে জানিয়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। গত ৫ ফেব্রুয়ারি এই রায়ের পর সাধারণ মানুষ এর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তা থেকেই তৈরি হয় গণ জাগরণ মঞ্চ।
এ প্রসঙ্গে গোলাম মাওলা রনি বলেন, যে বিষয় নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের সূচনা হয় তাকে সমর্থন করার সুযোগ ছিল না।