রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় বিরোধী দল বিএনপিসহ ২৮টি নিবন্ধিত দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই রোববার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিরোধী জোটের আন্দোলন ও হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে এ নির্বাচন সম্পন্ন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সকাল ৮টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ৫৯টি জেলার ১৪৭ আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে। এ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেছে। তাই সোয়া নয় কোটির বেশি ভোটারের মধ্যে ভোট দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন চার কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। ভোট কেন্দ্র থাকছে ১৮ হাজার ২০৮টি এবং কক্ষ হচ্ছে ৯১ হাজার ২১৩টি।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত
এর আগে বিতর্কিত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ৪৯ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সংসদের স্থায়িত্ব ছিল ১১ দিন। এরপর ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নির্বাচনে ১৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার ওইসব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ১২৭ জন, জাতীয় পার্টির ২০ জন, জাসদের তিনজন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির দুইজন ও জাতীয় পার্টি জেপির একজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচন কর্মকর্তা
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে মোট রিটার্নিং কর্মকর্তার সংখ্যা ৬৬ জন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ৫৭৭ জন। যে ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ওইসব আসনে ৬১ জন (দু’জন বিভাগীয় কমিশনার ও ৫৯ জেলা প্রশাসক) রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা রয়েছেন ২৮৭ জন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সংখ্যা ১৮ হাজার ২০৯ জন। সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ৯১ হাজার ২১৩ জন ও পোলিং কর্মকর্তা ১ লাখ ৮২ হাজার ৪২৬ জন। নির্বাচনে ইলেক্টোরাল তদন্ত কমিটির সংখ্যা ১০৩টি (দুই সদস্য বিশিষ্ট)। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৭ জন ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ২৯৪ জন। বিচারিক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা নির্বাচনী আইন লংঘনকারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সাজা দিতে পারবেন।
এদিকে বিরোধী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়ায় ভোটগ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে অনীহা জানিয়ে ইসিতে আবেদন আসছে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সংসদ নির্বাচনের ফল প্রকাশের সময় কমিশন সচিবালয় ও আশপাশ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কমিশনের নিরাপত্তা বাড়াতে ২৯ নভেম্বর কমিশন সচিবালয় থেকে পুলিশ প্রশাসনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া আগারগাঁওয়ে অবস্থিত নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও আশপাশ এলাকাজুড়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েনের পাশাপাশি র্যা ব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিয়মিত টহল দেন। কমিশন সচিবালয়ে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
নির্বাচনী খরচ
নির্বাচন পরিচালনা খাতে ৬৭ কোটি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা খাতে ১৪৭ কোটিসহ মোট ২১৪ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ৫৪ কোটি, পুলিশ-র্যা ব ৪৩ কোটি, আনসার ৪৪ কোটি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক লাখ, কোস্টগার্ড সোয়া আট লাখ ও বিজিবি ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ১৬৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।
পর্যবেক্ষক নেই
এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসছে না ইইউ, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, আমেরিকা, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ ও সংস্থা। এদের পথেই হাঁটছে সার্কভুক্ত দেশগুলো। নির্বাচন কমিশন থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ খরচের বড় একটি অংশ দেয়ার পরও আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। শুধু ভারত ও ভুটান থেকে চারজন পর্যবেক্ষক ঢাকায় আসছেন। এছাড়া দেশীয় ২২টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ১০ হাজার স্থানীয় পর্যবেক্ষক এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে বলে জানিয়েছে ইসি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নির্বাচন কমিশনের সংগঠন ফোরাম অব ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বডিস অব সাউথ এশিয়ার (ফেমবোজা) সদস্যদের মধ্যে ভারতের দু’জন প্রতিনিধি শনিবার ঢাকায় পৌঁছবেন। তারা হলেন ত্রিপুরার চিফ ইলেকটোরাল অফিসার আশুতোষ জিন্দাল ও ইলেকশন কমিশন অব ইন্ডিয়ার একজন ডিরেক্টর বি বি গার্গ। শুক্রবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে এ দু’জন পর্যবেক্ষককে প্রয়োজনীয় প্রটোকল ও প্রটেকশন দেয়ার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রাচার বিভাগকে চিঠি দিয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার ভুটানের দু’জন নির্বাচন কর্মকর্তা ঢাকায় পৌঁছেছেন। তারা হচ্ছেন ভুটান নির্বাচন কমিশনের ভোটার রেজিস্ট্রেশন এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ বিভাগের পরিচালক সোনামতবগাইয়াল এবং পাবলিক ইলেকশন ফান্ড ডিভিশনের ম্যানেজার তাশি দর্জি।
কমিশন সচিবালয়ের জনসংযোগ শাখার তথ্য অনুসারে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইউই সর্বোচ্চ ১৪৬ জন পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছিল। কমনওয়েলথ থেকে পাঠানো হয়েছিল ১৭ জন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা এনডিআই ও আইআরআই পাঠিয়েছিল ১৫৮ জন। ইউএসএইড থেকে নিয়োগ করা হয়েছিল ৬৪ জনকে। ইউএনডিপি থেকে এসেছিলেন ১২ জন। ‘এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন’ থেকে ৭৯ জন। জাপান ইলেকশন অবজারভার মিশন থেকে এসেছিলেন ২৫ জন। এ ছাড়া জার্মানি দূতাবাস থেকে একজন, বৃটিশ হাইকমিশন থেকে ২৪ জন, আমেরিকান দূতাবাস থেকে চারজন, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে ১১ জন, সুইডিশ দূতবাস থেকে দুই জন, নেপাল দূতাবাস থেকে একজন, ইন্ডিয়া ফোরাম এশিয়া থেকে ১২ জন এবং ওআইসি থেকে দুইজন। সর্বমোট ৫৮৫ জন পর্যবেক্ষক পাঠানো হয়েছিল।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মোতায়েন
সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন শেষ করতে তিন স্তরে সশস্ত্র বাহিনীসহ পৌনে চার লাখ সদস্য মোতায়েন করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর ৫০ হাজারের বেশি সদস্য মাঠে রয়েছে। এছাড়া ১৬ হাজার ১৮১ বিজিবি, র্যাব আট হাজার, পুলিশ ৮০ হাজার, আনসার দুই লাখ ২০ হাজার ও উপকূলীয় এলাকায় কোস্টগার্ডের দুই শতাধিক সদস্য মোতায়েন রয়েছে। সাধারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভোট কেন্দ্রে ২-৩ জন অস্ত্রসহ পুলিশ এবং পর্যাপ্ত আনসার নিয়োজিত থাকবে। মেট্রোপলিটন এলাকায় সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ ভোট কেন্দ্রে যথাক্রমে ৪ ও ৬ জন অস্ত্রসহ পুলিশ এবং পর্যাপ্ত আনসার দায়িত্ব পালন করবে। পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল ও হাওড় এলাকায় সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে যথাক্রমে তিন ও চার জন অস্ত্রসহ পুলিশ এবং পর্যাপ্ত আনসার নিয়োজিত থাকবে।
প্রচার ও যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
প্রচার ও যানবাহন চলাচল সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের পরিপত্রে বলা হয়েছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৭৮ বিধি অনুসারে ভোট গ্রহণ শুরুর পূর্ববর্তী ৪৮ ঘণ্টা হতে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা (শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ৭ জানুয়ারি বিকেল ৪টা) পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা ও সমাবেশ করা যাবে না। এ সময়ে কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড , ভোটার ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের কোনো ধরনের ভয়-ভীতি বা অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না। এ ধরনের অপরাধের জন্য দুই থেকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হবে।
পরিপত্রে আরো বলা হয়েছে, ৪ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা থেকে ৫ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, বেবিট্যাক্সি বা অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, লঞ্চ, ইজিবাইক, ইঞ্জিনবোট ও স্পিডবোটের চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। মহানগর এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস, পিকআপ ও জিপ চলাচলের ওপর উক্ত নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এ ছাড়া আজ রাত ১২টা থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। তবে জাতীয় হাইওয়ের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।
নির্বাচনের ফল ঘোষণা দ্রুত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায় থেকে ফল সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। শুক্রবার তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এবার ম্যানুয়েল ও ডিজিটাল উভয় পদ্ধতিতে ফলাফল সংগ্রহ করবে কমিশন।